বিত্ত গড়ার নোংরা রেসে কে নেই? সেটা ছলে-বলে, ন্যায়-অন্যায়ে যেভাবেই হোক। সেই পথে ধনে-জনে সফল হচ্ছেনও অনেকে। ছিটকে পড়ারাও হাল ছাড়ছেন না। বড় জোর সেক্টর পাল্টাচ্ছেন। দল বদলাচ্ছেন। মতলব থেকে টলছেন না। সাধ্য-সামর্থে না কুলালেও নিজ নিজ জায়গায় সম্রাট, বদি, খালেদ, মেনন হওয়ার বাসনা অনেকেরই। বালিশ, পর্দা, টিন কাণ্ড ঘটিয়ে অর্থশালী হওয়ার চেষ্টা ও মন-মানসিকতা জনে জনে। ব্যর্থ হলে আফসোস বা ঘৃণা। ভালো মানুষি। আঙুর ফল টক।
Advertisement
হাদিস-কালাম, তত্ত্ব, নৈতিকতায় শর্টকাট কাজকে নিরুৎসাহিত করা হয়। জ্ঞানীরা বলেন, শর্টকাটে সাফল্য আসে না। ধর্মমতে, শর্টকাট গুনাহর কাজ। হাদিসে হযরত মুহাম্মদ (স:) এর জবানিতে বলা আছে, আল-আজলুম মিনাশ শায়াতিন। বাংলা তরজমায় এর অর্থ: তাড়াহুড়া করা শয়তানের কাজ। কিন্তু, বাংলাদেশে হাল বাস্তবতায় চর্চা হচ্ছে উল্টোটা।
এখানে শর্টকাটে ধনাঢ্য-কোটিপতি হওয়ার নানান ম্যাজিক বেরিয়েছে। জলদি-দ্রুত কাজ করা বা কাজ সারানোর মধ্যে বাহবা বেশি। সাফল্যও নিশ্চিৎ। বিনিময়ে তারা একেকজন একেকটা আইডল। অনুসরণীয় মডেল-আইটেম। কতো সাগরেদ-মুরিদ জুটছে এই ওস্তাদদের? শুধু খেদমত নয়, তাদের সালাম-আদাব দিয়ে ধন্য হওয়া পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী শত-শত, হাজারে হাজার। কুমিল্লার খালেদ, ফেনীর সম্রাট, চাঁদপুরের ফিরোজদের বেড়ে ওঠার পর্বগুলো জানলে এর সঙ্গে দ্বিমত থাকার কথা নয়।
শর্টকাটের বাংলা খুব দ্রুত বা অল্প সময়। কিন্তু তা আপেক্ষিক। অল্প সময় বলতে কতো অল্প? দুই- চার মাস অল্প সময়। আবার কারো কারো জন্য দুই-চার বছরও অল্প সময়। ধনী কথাটাও আপেক্ষিক। কেউ এক লাখ টাকার মালিক হয়ে ধনী। আবার অনেকে কয়েক শত কোটি টাকায়ও ধনী নন। আবার হরহামেশাই শোনা যায়, সৎ পথে কোনদিনই রাতারাতি ধনী হওয়া যায় না।
Advertisement
অসৎ ও পঙ্কিল পথে যতো দ্রুত অভাবনীয় সাফল্য ধরা যায়, হকহালালি পথে গোটা জীবনেও তা মেলে না। আবার অসৎ পথেরও মানদণ্ড নেই। একে সংজ্ঞায় আবদ্ধ করাও কঠিন। চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি, মদ-জুয়া, কালোবাজারি, ঠেক-ঠববাজিকে গুরুতর অসৎ কাজ মনে না করার মানসিকতা অনেকের। আবার মিনিট কয়েক কাজে ফাঁকি, দু’চার টাকা কম-বেশি করাকে মারাত্মক অপরাধ মনে করার মন-মননও আছে কারো কারো।
ক্যাসিনো, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, পারসেন্টেজের এতো হুল্লোড়ও শর্টকাটের একেকটি মওকা। অবাধে দ্রুত সাকসেস হচ্ছেন অনেকে। এই উদাম দৌড়ে ফেলের সংখ্যা কম। ক্ষমতাসীন কারো আশীর্বাদ পেলে সাকসেসের গ্যারান্টি মেলে দ্রুত। সবাই সম্রাট, খালেদ, কাওসার, সাঈদ হতে পারেন না। আবার একেবারে কমও যান না। সম্ভবত নোংরা দৌড়ের বহু সাফল্যগাথার গল্প তাদের জানা।
মহাভারতের উপদেশমূলক এক গল্পে না-কি বলা আছে: যে বসে থাকে তার ভাগ্যও বসে যায়। যে শুয়ে পড়ে তার ভাগ্যও শুয়ে যায়। যে এগিয়ে চলে তার ভাগ্যও এগিয়ে থাকে। গল্পটির মর্ম আসলেই উৎসাহ জাগানিয়া। উল্টাপাল্টা পথে সাফল্যকামীদের জন্য বেহুঁশ হওয়ার মতো। শর্টকাটে সাফল্য তাদের কাছে আগে-পরে ধরাও দিচ্ছে।
সিঁড়ির বদলে লিফ্ট খোঁজায় তাড়নাদায়ক। ওয়ান-টুতে অনেক কিছুরই সমাধান পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে গড়পড়তা প্রায় সবাই। মিনিটে চেক ক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছে তাদের। ম্যারেজ রেজিস্ট্রি হয়ে যাচ্ছে কয়েক মিনিটে। ধর-মার, ফাস্ট ফুড, ঝটপট রান্না, ছয়-সাত মাসে সিজারিয়ান বেবি, এক মিনিটে কালার ফটো, ঝোপেঝাড় বা রিকশাতেই শরীরচর্চা কি-না মিলছে?
Advertisement
এই বোধহীন দৌড়ে জায়গামতো পৌঁছতে না পারলেও থামার বোধ থাকছে না। দাড়ি-কমা দেয়ার খেই থাকছে না। আরো জোরে, আরো জোরে ছুটতে গিয়ে পেছনের জনের ল্যাং খেয়ে ধরাশায়ী হলেও না। বরং তখন চলে সামনের জনকে ল্যাং মারার ব্যস্ততা।
শর্টকাটের এমন মোক্ষম সম্ভাবনা বোকাও চালাক হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, বোধসম্পন্ন হতে চান না। এ দৌড় বোবাকেও বাকশক্তি দিচ্ছে। রক্ষক-গডফাদার জুটছে। পা’হীন ব্যক্তিও লাফায় সেখানে। গড়িয়ে গড়িয়ে ছোটে। অথবা কৃত্রিম পা লাগিয়ে হাইজাম্প দেয়। এ দৌড়ে ক্লান্তিহীন তারা। অন্তহীন এ দৌড়ের শুরু আছে শেষ নেই। মোজ-ফুর্তিও বেশ। প্রভাবের সঙ্গে প্রতিপত্তি চলে আসে আপনাআপনি।
মুখে বা পেছনে নিন্দা করলেও সামনাসামনি এ দৌড়বিদদের ব্যাপক সম্মান মিলছে। রাজনীতির সঙ্গে সামাজিক স্বীকৃতি পেতেও সময় লাগে না। শর্টকাটে বিত্তবান হওয়ার চেষ্টায় বলিয়ানদের অনকেকে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায় মতিঝিল ক্লাবপাড়ার একটু দূরে শেয়ারবাজারে ক্যাসিনোতে ঝাঁপ দিতে। অফিসের ফাইলপত্র ঘাঁটার চেয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে দিনশেষে লাভ গোনা স্বর্গীয় অনেকের কাছে। সেখানে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বহু গৃহিণীও রয়েছেন।
বছরের পর বছর ধরে জমানো টাকায় কোন ভাবী কোন কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন তারা বেশ ভালো জানেন। কেউ কেউ বাবার পেনশনের টাকা, কেউ জমি বা মায়ের গয়না বিক্রির টাকাও বিনিয়োগ করেন। শেয়ারবাজারের আসল স্বর্গীয় মেওয়া কারা খায় সেটা তাদের জানার সৌভাগ্যও হয় না। সর্বস্ব হারানোর পর সেটা জানার বোধ-বুদ্ধিও থাকে না কারো। কবর বা চিতায় না যাওয়া পর্যন্ত কিংবা প্যারালাইজড হয়ে চিত হয়ে বিছানায় না পড়া পর্যন্ত এ দৌড় থামে না। থামবে না। চলুক সার্কাস। মরছে মরুক। আর বেঁচে গেলে সম্রাট, শামীম, খালেদ হয়েই থাকুক। ঠেকাবে কে? ঠেকানোর ঠেকাই বা লেগেছে কার?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর