ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়, অটোয়া ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং টেররিজম ইন সাউথ এশিয়া : বিয়ন্ড স্টাটিস্ট ডিসকোর্সেস’ নামক গ্রন্থের রচিয়তা তিনি।
Advertisement
তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। বলেন, ‘আফগানরা কী রকম মারমুখী, তা যুক্তরাষ্ট্র এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ে তালেবানরাই লাভবান হবে।’ দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে কাশ্মীর, আসামের এনআরসি ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও গুরুত্ব পায়। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : আগের পর্বে যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন। পাকিস্তান ও ভারত- দুই পক্ষই তালেবানের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আলোচনায়। এ আলোচনার মধ্য দিয়ে ভারত বাদ পড়ল কি-না?
ইমতিয়াজ আহমেদ : হ্যাঁ। ভারত প্রায় বাদ-ই পড়েছে। কারণ, সমঝোতার মধ্যে আমরা ভারতের কোনো ভূমিকা দেখতে পাইনি। আবার না থাকাটাও স্বাভাবিক। আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের কোনো সীমানা নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক খারাপ হওয়ায়, ভারতের সঙ্গে ভালো হয়। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে ভারত সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে সেখানে ভূমিকা রাখতে। চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারত আফগানিস্তানে কর্তৃত্ব দেখাতে পারবে না। কারণ ভারতের অর্থনীতি সেটি সমর্থন করে না।
Advertisement
আবার ভারত-কে আলোচনায় এনে সমঝোতায় বিশেষ গুরুত্ব পেত, তা-ও আমি মনে করি না।
জাগো নিউজ : চুক্তিতে তালেবান লাভবান হলে পাকিস্তানের লাভ। এ প্রশ্নে ভারত বিরাগভাজন হতে পারে কি-না?
ইমতিয়াজ আহমেদ : কাতারে সমঝোতা বৈঠকে না থাকতে পেরে ভারত এমনিতেই নাখোশ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর ভরসা করা যায় না, তা হয়তো ভারতও বুঝতে পারছে। এটি ভারতের জন্য একটি শিক্ষাও বটে। তবুও ভারত চাইবে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার, অন্তত বিনিয়োগ প্রশ্নে।
জাগো নিউজ : তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি আলোচনায় ভারতের না থাকা আর কাশ্মীর প্রশ্নে ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্যে কোনো যোগসূত্র পান কি-না? বিশেষ করে পাকিস্তানকে চাপে রাখার জন্য?
Advertisement
ইমতিয়াজ আহমেদ : আমি ঠিক এভাবে পর্যবেক্ষণ করিনি। তবে কাশ্মীরের বিষয়ে ভারত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার দায় হয়তো বিজেপি সরকার-কে নিতে হচ্ছে। কিন্তু ভারত তো নিজের অবস্থান থেকে কাশ্মীর-কে দেখে। কাশ্মীরে ছয় লাখ সৈন্য রেখেও শান্ত করা যাচ্ছিল না।
কাশ্মীরে সশস্ত্র হামলা যে হারে বেড়ে যাচ্ছিল, তাতে গোয়েন্দারা ব্যর্থ হচ্ছিল; এটি বোঝাই যাচ্ছিল। সব হামলাকারী যে পাকিস্তান থেকে আসছে, তা ঠিক নয়। অনেকেই কাশ্মীর থেকে তৈরি হচ্ছিল। তরুণ-যুবকরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল, তাতে কাশ্মীর ভারতের প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল।
এসব প্রশ্নেই কাশ্মীরকে পুরোপুরি দিল্লির অধীনে আনা জরুরি ছিল। যদিও দিল্লির শাসনই সেখানে চলেছে। কাশ্মীর দখলে রাখার শেষ চেষ্টা করছে ভারত। যে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছিল, তারও যে খুব বাস্তবায়ন ছিল, তা নয়। আইনত, কোনো ভিত্তি ছিল না সে মর্যাদার।
জাগো নিউজ : শেষ চেষ্টায় ভারতের পক্ষে আসলে কী ফল আসবে? আপনার বিশ্লেষণ কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ : গত ৭০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে বলতে হয়, ভারত খুব সহজে কাশ্মীর-কে বাগে আনতে পারবে না। ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে ভারত মনে করেছে, কাজটি ভালো করেছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
কার্যকারিতা না থাকলেও কাশ্মীরিরা মনে করতেন ৩৭০ ধারার একটি সাংকেতিক মূল্য ছিল। তারা এ ধারাকে সামনে রেখেই এগিয়ে যাচ্ছিল। এটি আর থাকল না।
এখন কাশ্মীরিদের সামনে দুটি পথ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। হয় দিল্লির সিদ্ধান্ত মেনে নেবে, নতুবা মানবে না। এতদিনেও মানেনি। এখন তরুণদের মধ্যে যে চেতনা কাজ করছে, ভারত সেখানে ব্যাপক উন্নয়ন করলেই তারা মেনে নেবে, আমি তা বিশ্বাস করি না। কিন্তু ভারত উন্নয়ন দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে।
উন্নয়ন মোড়কে কাশ্মীরি জাতিসত্তাকে ঢেকে ফেলতে পারবে না ভারত। সিঙ্গাপুর, চীন, হংকংয়ের উন্নয়ন আর কাশ্মীরের উন্নয়ন আলাদা। কাশ্মীরবাসী এমন উন্নয়ন চায় কি-না, সেটাই আসল বিষয়। কাশ্মীরে জাতিগত ব্যবধানের চেয়ে ধর্ম একটি বড় বিষয় হয়ে আছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নিয়ে কাশ্মীরের মুসলমানদের শাসন করা মুশকিল হবে।
জাগো নিউজ : তাহলে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ : কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ মানুষের আন্দোলনের ওপর নির্ভর করবে। তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে রিট করা হয়েছে। রায়ে অন্য কিছুও আসতে পারে। আমি মনে করি, কাশ্মীরে আপাতত আলো আসবে না। ভারতের অনেকেই কাশ্মীরের মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। অনেক রাজনৈতিক দলও ৩৭০ ধারা বাতিলের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। এতে বোঝা যায়, বিজেপির মতো করে সহজে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান আসবে না।
জাগো নিউজ : এখানে পাকিস্তানের ভূমিকা কেমন হবে?
ইমতিয়াজ আহমেদ : কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান খুব বড় ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করি না। কাশ্মীর-কে ভাগ করে ভারত-পাকিস্তান উভয়ই নিজেদের মতো করে সাজিয়েছে। আজাদ কাশ্মীরে পাকিস্তান মুক্তি আনতে পারেনি। ভারত মুক্তি দিতে পারেনি জম্মু-কাশ্মীরে।
পাকিস্তান নিজের রাজনীতির মধ্য থেকে এমন হুমকি দেবেই। পাকিস্তান কাশ্মীরে নৈতিক সমর্থন দিতেই পারে। এমনকি অন্যরকম সমর্থনও থাকতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধে যাবে না বলে বিশ্বাস করি। কারণ এতে করে ভারত কাশ্মীরে একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাবে। এটি হলে কাশ্মীরের স্বাধীনতার চাহিদা আরও পিছিয়ে যাবে। পাকিস্তান তার দেশে যে উন্নয়ন করতে যাচ্ছে, তাতে যুদ্ধে গেলে ক্ষতি হবে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে হৈচৈ করে বিশেষ সাড়া ফেলতে চাইবে। তাছাড়া সিদ্ধান্ত নিতে কাশ্মীরবাসীকেই সুযোগ দেয়া উত্তম হবে বলে মনে করি।
মূলত কাশ্মীরিদের প্রতিরোধের ওপরই পরবর্তী ধারা তৈরি হবে। কাশ্মীরিরা পাকিস্তানের সহায়তা কতটুকু চায়, সেটাও দেখার বিষয়। এ ইস্যু নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধালে কাশ্মীরের ক্ষতিই বেশি হবে।
জাগো নিউজ : কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণে ভারত আরও আক্রমণাত্মক হতে পারে কি-না?
ইমতিয়াজ আহমেদ : ভারত শুরু থেকেই কাশ্মীর বিষয় নিয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থায় আছে। নইলে তো সেখানে ছয় লাখ সৈন্য রাখার কথা নয়। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সৈন্য মোতায়েন করা এলাকা হলো কাশ্মীর।
ভারত হয়তো কাশ্মীরে ভিন্ন নীতিতে হাঁটতে চাইবে। উন্নয়ন এবং মূল ভারত থেকে সেখানে মানুষ নিয়ে ভারসাম্য তৈরি করতে চাইবে। শেষ পর্যন্ত ভারতের এ নীতি আসলে টিকবে কি-না, তা কাশ্মীরিদের প্রতিরোধের ওপর নির্ভর করবে।
এএসএস/এমএআর/এমএস