এম আই সিমেন্ট ২০১১ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ৩৩৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। এজন্য ১০ টাকা দামের একটি শেয়ার আইপিওতে বিক্রি হয় ১১১ টাকা ৬০ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে প্রিমিয়াম বাবদ নেয়া হয় ১০১ টাকা ৬০ পয়সা। এমন উচ্চ প্রিমিয়াম নেয়া কোম্পানিটির শেয়ারের বর্তমান (১৬ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে) দাম ৫৫ টাকা ৪০ পয়সা।
Advertisement
উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া অপর এক কোম্পানি জি বি বি পাওয়ার। ২০১২ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটি আইপিও’র মাধ্যমে ৮২ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এজন্য ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে প্রিমিয়াম নেয়া হয় ৩০ টাকা। অর্থাৎ আইপিওতে শেয়ার ইস্যু করা হয় ৪০ টাকা করে। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ টাকা ২০ পয়সায়।
শুধু এম আই সিমেন্ট বা জি বি বি পাওয়ার নয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন থেকে উচ্চ প্রিমিয়ামের অনুমোদন নেয়া বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম এমন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন উচ্চ প্রিমিয়ামে যে কটি প্রতিষ্ঠানের আইপিও অনুমোদন করেছে তার মধ্যে ২৪টির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে। এমনকি লেনদেন শুরুর পর এক বছর পার হওয়ার আগেই শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
Advertisement
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে একের পর এক দুর্বল কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। ফলে আইপিওতে উচ্চ প্রিমিয়াম নেয়া কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো- কোম্পানিগুলো যোগ্যতার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম পেয়েছে। এক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপশি সার্বিক পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘পুঁজিবাজারে শুদ্ধি অভিযান এখন সময়ের দাবি’ বলে মত দিয়েছেন।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে মহাধসের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে দেশের পুঁজিবাজার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ২০১১ সালের মে মাসে এম খায়রুল হোসেনকে বিএসইসির চেয়ারম্যান করে বর্তমান কমিশন গঠন করে। এরপর টানা আট বছর খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি পরিচালিত হচ্ছে।
এ আট বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ৪৬টি কোম্পানি প্রিমিয়াম নিয়ে আইপিওতে শেয়ার ছেড়েছে। এর মধ্যে ২৪টির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে দুটির দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমেছে। এছাড়া পাঁচটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
প্রিমিয়াম নিয়ে আইপিওতে আসার পরও শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া প্রতিষ্ঠান দুটি হলো- জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও অ্যাপোলো ইস্পাত। ২০১১ সালে আইপিও অনুমোদন পাওয়া জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ২৫ টাকা দামে শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এজন্য ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটি ১৫ টাকা প্রিমিয়াম নেয়। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ছয় টাকা ৬০ পয়সায়।
Advertisement
প্রিমিয়াম নেয়ার পরও শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া অপর প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো ইস্পাত ২০১৩ সালে আইপিও’র মাধ্যমে বাজার থেকে ২২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এ টাকা উত্তোলনের জন্য কোম্পানিটি ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে প্রিমিয়াম নেয় ১২ টাকা। অর্থাৎ আইপিওতে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয় ২২ টাকায়। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৬০ পয়সায়।
চলতি বছর (২০১৯ সাল) তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়েছে দুটি কোম্পানি। এর মধ্যে একটির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে। শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে যাওয়া এস্কয়ার নিট কম্পোজিট আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। এজন্য ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটি প্রিমিয়াম পেয়েছে ৩০ টাকা। চলতি বছরের এপ্রিলে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩৩ টাকা ৬০ পয়সায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের মধ্যে শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে।
২০১৮ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দুটি উচ্চ প্রিমিয়াম পায়। ওই দুটি কোম্পানির শেয়ারের দামই বর্তমানে ইস্যুমূল্যের নিচে অবস্থান করছে। এর মধ্যে ২৬ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৩৬ টাকায় আইপিওতে শেয়ার ইস্যু করা আমান কটনের দাম দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা ৪০ পয়সায়। ৬২ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৭২ টাকায় শেয়ার ইস্যু করা বসুন্ধরা পেপারের দাম দাঁড়িয়েছে ৫৮ টাকা ৬০ পয়সায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, তালিকাভুক্তির কিছুদিনের মধ্যে শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে যাওয়ার অর্থ হলো- কোম্পানিগুলো যোগ্যতার চেয়ে বেশি প্রিমিয়াম নিয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। এতে সার্বিক পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূলত গত কয়েক বছরে একের পর এক দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণেই বর্তমানে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
শেয়ারের দাম ইস্যু মূল্যের নিচে নামা কোম্পানিগুলোর চিত্র-
কোম্পানির নাম
প্রিমিয়াম
আইপিওতে ইস্যুমূল্য
শেয়ারের বর্তমান দাম
এম জে এল বাংলাদেশ
১০৫ টাকা
১১৫ টাকা
৮২ টাকা ৬০ পয়সা
জি এস পি ফাইন্যান্স
১৫ টাকা
২৫ টাকা
১৪ টাকা ২০ পয়সা
ইউনিক হোটেল
৬৫ টাকা
৭৫ টাকা
৪৮ টাকা
আর্গন ডেনিম
২৫ টাকা
৩৫ টাকা
২২ টাকা ১০ পয়সা
ওরিয়ন ফার্মা
৫০ টাকা
৬০ টাকা
৩০ টাকা ৫০ পয়সা
ফারইষ্ট নিটিং
১৭ টাকা
২৭ টাকা
১২ টাকা ৯০ পয়সা
সাইফ পাওয়ার
২০ টাকা
৩০ টাকা
১৭ টাকা ২০ পয়সা
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড
২৫ টাকা
৩৫ টাকা
১৪ টাকা ৬০ পয়সা
হামিদ ফেব্রিক্স
২৫ টাকা
৩৫ টাকা
১৭ টাকা ৫০ পয়সা
রিজেন্ট টেক্সটাইল
১৫ টাকা
২৫ টাকা
১২ টাকা ৭০ পয়সা
একমি ল্যাবরেটরিজ
৬৭ টাকা
৭৭ টাকা
৭১ টাকা ৫০ পয়সা
বেঙ্গল উইনডোজ
১৫ টাকা
২৫ টাকা
২৩ টাকা ৩০ পয়সা
মতিন স্পিনিং
২৫ টাকা
৩৫ টাকা
৩৪ টাকা ৬০ পয়সা
পেনিনসুলা চিটাগাং
২০ টাকা
৩০ টাকা
২২ টাকা ৮০ পয়সা
রতনপুর স্টিল রি-রোলিং
৩০ টাকা
৪০ টাকা
৩৬ টাকা ১০ পয়সা
তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ
১৬ টাকা
২৬ টাকা
১৬ টাকা ৯০ পয়সা
সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ
১০ টাকা
২০ টাকা
১৮ টাকা ৪০ পয়সা
এমএএস/এমএআর/পিআর