দেশজুড়ে

এরশাদের আসনের উপনির্বাচন : পাল্টে যাচ্ছে সমীকরণ

ঘনিয়ে আসছে রংপুর-৩ (সদর) আসনের উপনির্বাচন। দিন যতই গড়াচ্ছে ততই পাল্টে যাচ্ছে ভোটের সমীকরণ। মহানগর জাপার সভাপতি ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এবং মনোনয়নপ্রত্যাশী মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসীরসহ একটি অংশ মাঠে না নামলেও মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে সাদ এরশাদকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে তার পাল্লা ভারী হতে চলেছে। ৫ অক্টোবর সনাতন ধর্ম্বালম্বীদের সপ্তমীর দিন হওয়ায় হিন্দু ভোটাররা ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকতে পারেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। এক্ষেত্রে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে কিছুটা বেকায়দায় পড়তে পারেন সাদ।

Advertisement

এদিকে এরশাদের ভাতিজা স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য আসিফ শাহরিয়ারও দাবি করছেন, তার পক্ষে জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীসহ আওয়ামী লীগের একটি অংশের সমর্থন রয়েছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় প্রার্থীর ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে তিনি ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে।

গত সংসদ নির্বাচনে এরশাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এই আসনে ৫৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন ২০ দলীয় জোটের রিটা রহমান। এবারও তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। তার পক্ষে বিএনপির একটি অংশকে মাঠে দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতসহ বিএনপি এক হলে ত্রিমুখী লড়াই হবে এবারের নির্বাচনে -এমনটাই মনে করছেন ভোটাররা।

তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় ভোটারসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

Advertisement

নগরীর মুন্সিপাড়া এলাকার ভোটার সুমন মিয়াসহ অনেকে জানান, স্থানীয় প্রার্থী হিসেবে যিনি যোগ্য তাকেই ভোট দেবেন। এক্ষেত্রে তাদের কাছে দলীয় প্রতীক কোনো বিষয় নয়।

তবে প্রার্থী যেই হোক না কেন দীর্ঘদিন ধরে লাঙল প্রতীকে ভোট দিয়েছেন এবং এ নির্বাচনে ওই প্রতীকেই ভোট দেবেন বলে জানান বড়বাড়ি এলাকার নয়ন মিয়াসহ একাধিক ভোটার।

নির্বাচনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস মিলছে কি-না? জানতে চাইলে কবি ও লেখক জাকির আহমদ বলেন, প্রচারণার শুরুতে বিভিন্ন জোট-মহাজোট ও নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েনি। গত শনিবার থেকে নির্বাচনী মাঠ সরগরম হতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত জোট-মহাজোট আর স্থানীয় প্রার্থীর ইস্যুতে নেতাকর্মীরা মাঠে নামলে ত্রিমুখী লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল বলেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী দেয়া হলেও তা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই এবং জাতীয় পার্টি মহাজোটের একটি অংশ সেক্ষেত্রে আমরা মহানগর আওয়ামী লীগ সাদ এরশাদের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

Advertisement

তবে জেলা আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এ বিষয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ সভা অুনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে সাদ এরশাদের পক্ষে কাজ করা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

এদিকে বিএনপির প্রার্থী রিটা রহমানের পক্ষে এতদিন প্রচারণায় অংশ না নিলেও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিজু বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট নিয়ে আমরা শঙ্কিত। এরপরও কেন্দ্রীয় নেতারা শিগগিরই রংপুরে আসবেন। তারা এলে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে রংপুর বিএনপি এক হয়ে কাজ করবে।

অতীতের ভোটগ্রহণে অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ভোট অবাধ ও স্বচ্ছ হলে বিএনপি প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়ী হবে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার বলেন, ‘আমি এর আগে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসনের সংসদ সদস্য ছিলাম। রাজনৈতিক মাঠে আমি পরীক্ষিত। রংপুরে সপরিবারে বসবাস করি। নগরবাসীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। জনগণ সাদকে চেনে না। সে দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল। একজন বহিরাগত প্রর্থীকে মনোনয়ন দেয়ায় ভোটাররা এরশাদ পরিবারের সন্তান হিসেবে আমাকেই ভোট দেবে বলে আশা করি।’

জাতীয় পার্টির প্রার্থী রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ বলেন, আসিফ আমার ভাই। তিনি নির্বাচন করতেই পারেন। রংপুরের লোকজনের কাছে আমি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সাড়া পাচ্ছি। আমার বাবা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রংপুরবাসী লাঙল প্রতীকে ভোট নিয়ে আমাকেই নির্বাচিত করবে বলে আশা করছি।

এদিকে রংপুর মহানগর জাপা সভাপতি সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান, সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসিরসহ মহানগর জাপার অধিকাংশ নেতাকর্মী এখন পর্যন্ত সাদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না।

সিটি মেয়র মোস্তফা অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, বহিরাগত কাউকে মনোনয়ন দিলে তিনি কাজ করবেন না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, রংপুরের জনগণ বা ভোটারদের মতামতকে গুরত্ব না দিয়ে দলের প্রার্থী নির্বাচন করা হয়েছে। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলগুলোর যে বিচক্ষণতার দরকার ছিল এবার তার প্রতিফলন ঘটেনি।

তিনি বলেন, একদিকে পারিবারিক দ্বন্দ্ব কাজ করছে অন্যদিকে উড়ে এসে জুড়ে বসাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। সাধারণ ভোটারদের মাঝে আগ্রহ নেই।

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির রংপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন।

তিনি বলেন, ভোটে কোনো লড়াই হবে না। সাধারণ মানুষ কী ভোট দিতে যাবে? ফলাফল কী হবে তাতো নির্ধারণ হয়ে গেছে।

এদিকে ভোটগ্রহণের তারিখ পরিবর্তনের দাবিতে রংপুর জেলা ও মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন দফতরে স্মারকলিপি দেয়ার পর দিনব্যাপী অনশন শুরু করেছেন হিন্দু নেতারা। রোববার সকাল থেকে রংপুর প্রেস ক্লাবের সামনে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের ব্যানারে এ অনশন শুরু করেন তারা। ভোট না পেছালে বর্জনের হুমকি দেন স্থানীয় হিন্দু নেতারা।

এ বিষয়ে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ রংপুর জেলা কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি সুশান্ত ভৌমিক বলেন, ভোটগ্রহণের তারিখ পরিবর্তন করা না হলে ভোটসহ পূজা উদযাপনে সরকারি বরাদ্দ বর্জন করা হবে।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য ঘোষণা করা হয় রংপুর-৩ আসন। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে এ আসনটি ছিল জাতীয় পার্টির দখলে।

জাতীয় পার্টির রাহগির আল মাহি সাদ ওরফে সাদ এরশাদ, বিএনপির রিটা রহমান, স্বতন্ত্র প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার ওরফে আসিফ শাহরিয়ার ছাড়াও এনপিপির শফিউল আলম, গণফ্রন্টের কাজী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং খেলাফত মজলিসের তৌহিদুর রহমান মণ্ডল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩টি ওযার্ডের মধ্যে ২৫টি ওয়ার্ড (১ থেকে ৮ নং ওয়ার্ড ব্যতিত) এবং সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনের মোট ভোটার ৪ লাখ ৪২ হাজার ৭২। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই এবারও এ আসনে ইভিএমএ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

জিতু কবীর/এমবিআর/এমএস