বিশেষ প্রতিবেদন

র‌্যাবকে ১০ কোটির প্রস্তাব দেন জি কে শামীম

শুক্রবার ভোর থেকেই যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের নিকেতনের অফিস ঘিরে রাখে র‌্যাব। একপর্যায়ে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম নিকেতনে এলে শুরু হয় অভিযান আর কার্যালয়ে তল্লাশির প্রস্তুতি।

Advertisement

র‌্যাব কর্মকর্তাদের অভিযান ও তল্লাশি করতে বারণ করেন জি কে শামীম। এর বদলে এক কর্মকর্তাকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ প্রস্তাব করেন তিনি। তবে সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে অভিযান চালায় র‌্যাব। জব্দ করা হয় নগদ টাকা, এফডিআরসহ মাদক

র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার-বিন-কাশেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জি কে শামীম তার অফিস ও বাসায় অভিযান না চালাতে এবং গ্রেফতার এড়াতে আমাকে ১০ কোটি টাকার ঘুষ প্রস্তাব করেছিলেন। প্রস্তাব আমলে না নিয়ে আমরা জি কে শামীমের কার্যালয়ে অভিযান চালাই, তাকেসহ তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করি।’

তিনি বলেন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মানি লন্ডারিংয়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তিনি এখন ডিবি হেফাজতে।

Advertisement

শামীমকে রিমান্ডে নেয়ার আগে জিজ্ঞাসাবাদে করে র‌্যাব। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে শামীম গণপূর্ত অধিদফতরের ২০ জন সাবেক সরকারি কর্মকর্তার নাম বলেছেন, যাদের মাসে ২-৫ লাখ টাকা দিতেন তিনি। এর বদলে তারা শামীমকে ঠিকাদারির কাজের টেন্ডার পেতে সাহায্য করতেন।

সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানান যে, ঢাকার বাসাবো ও নিকেতনে তার অন্তত পাঁচটি বাড়ি রয়েছে। রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট আছে। গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে তার বাড়ি রয়েছে। তার বাসাবো ও নিকেতনের বাড়ি দুটি খুবই অত্যাধুনিক। সেখানে গণপূর্তের যুগ্ম ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তার সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসায়িক আলাপ ও লেনদেন করতেন। সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল।

সূত্র আরও জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ যুবলীগ নেতা সরকারি বড় বড় প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করেন। জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানান, ঠিকাদারির কাজ পাইয়ে দিতে তিনি দুই কর্মকর্তাকে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন।

জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম আরও জানান, প্রতি টেন্ডারে ৮-১০ শতাংশ কমিশন দেয়া লাগত তার। অনেক সময় নির্দিষ্ট কমিশনের পরও ঘুষ দিতে হতো। পূর্ববর্তী ও ভবিষ্যতের কাজ পেতে এখন পর্যন্ত গণপূর্ত অধিদফতরের সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে তিনি ঘুষ হিসেবে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা দেন। গণপূর্তের ঢাকা জোনের আরেক সদ্য সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাইকেও ঘুষ দিয়েছেন ৪০০ কোটি টাকা- এমন দাবি করেন তিনি।

Advertisement

সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম অবসরে যান। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন সেখানে একচ্ছত্রভাবে ঠিকাদারি কাজ পান শামীম। তবে রফিকুল অবসরে যাওয়ার পরও গণপূর্তে শামীমের প্রভাব কমেনি। কমিশন দিয়ে নিজের প্রভাববলয় বজায় রাখেন তিনি। গণপূর্তে এমন কথা প্রচলিত আছে, ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতে নানা দফতরে 'তদবির' করে রফিকুলকে প্রধান প্রকৌশলী বানিয়েছিলেন শামীম।

এ বিষয়ে জানতে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলে তিনি তা রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে এসএমএস পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। আবদুল হাইয়ের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটি ‘আনরিচেবল’ পাওয়া যায়।

র‌্যাব সূত্র জানায়, সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা জি কে শামীম ক্ষমতাসীন দলের ভুয়া পরিচয় দিয়ে চলাফেরা করতেন। একসময় পরিচিত ছিলেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের 'ডান হাত' হিসেবে। ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদকও ছিলেন তিনি। তবে ক্ষমতার পালাবদলে শামীমও তার পরিচয় বদলে ফেলেন। রাতারাতি ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগে ভিড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

যেসব প্রকল্পে কাজ করছেন জি কে শামীম

শামীম বর্তমানে উত্তরার আশকোনায় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকায় র‌্যাব সদর দফতর, ১৩ কোটি টাকায় পোড়াবাড়িতে র‌্যাব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৫০০ কোটি টাকায় আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবন, ১৫০ কোটি টাকায় আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের নতুন ভবন, ৫০ কোটি টাকায় এনজিও ভবন, ১৫০ কোটি টাকায় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, ১২ কোটি টাকায় পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ৩০ কোটি টাকায় বিজ্ঞান জাদুঘর, ১৫০ কোটি টাকায় সচিবালয়ের সম্প্রসারিত ভবন, ১০ কোটি টাকায় বাসাবো বৌদ্ধমন্দির, ১৫০ কোটি টাকায় হিল ট্র্যাক্টস ভবন ও ১৫০ কোটি টাকায় মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শামীমের প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, ল্যাবরেটরি মেডিসিন ভবন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও কেবিনেট ভবন নির্মাণসহ বেশকিছু প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পের কাজ পেতে মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়েছেন শামীম। রূপপুরের কাজে ১০ শতাংশ কমিশন দিয়েছেন।

জি কে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে র‌্যাবের পরিচালক সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, ‘শামীমকে আমরা সীমিত সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পেয়েছিলাম। এই সীমিত সময়ে তিনি বলেছিলেন যে তিনি অসুস্থতা বোধ করছেন।’

এআর/জেইউ/জেএইচ/এমএস