শুদ্ধি। সংস্কার। এই দুই দুইয়ের আপাত যোগফল অভিযান। আর সেই অভিযানের প্রতিফল, বাংলাদেশের ক্লাব সংস্কৃতির অন্যরকম এক স্বরুপ উন্মোচিত হলো। এই দেশে হাউজি, মদ , জুয়া ছাপিয়ে ক্লাবগুলো পরিণত হয়েছে ক্যাসিনোতে!
Advertisement
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। ক্যাসিনো খেলতে অনেক বিত্তবান উইকেন্ডে আশপাশের বিভিন্ন দেশে উড়াল দেন। পয়সা আছে। সামর্থ্য আছে। মনে ইচ্ছা আছে। উড়াল তারা দিতেই পারেন। কিন্তু ক্যাসিনো এখন ফকিরাপুলে, এটা কী জানতেন এদেশের আমজনতা? মনে হয় না। তবে প্রশাসন, পুলিশ, ক্লাব কর্তারা জানতেন না, সেটা বলা যাচ্ছে না। তারা শুধু জানতেন তা নয়। প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খেলাধুলার ক্লাবে গজিয়ে উঠেছে ক্যাসিনো। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়া না পেলে এ ধরনের অনৈতিক কমর্কাণ্ড খোদ রাজধানীতে কীভাবে চলে!
আর এই রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতাসীন দলের ছায়াতলে থেকে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেছেন। অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। তাদের সেই অনৈতিক কাজকর্মের ফিরিস্তি খোদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছানোর পর শুরু হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। সেটা প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায়। সে কারণে বহুচর্চিত বিষয়, বহুবার উচ্চারিত বাক্যটা আবারও লিখতে হচ্ছে। সব কিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয়, সিদ্ধান্ত দিতে হয়, তাহলে বাকিরা কী করেন? সেটা দলে, প্রশাসনে, সরকারে সব জায়গায়।
প্রধানমন্ত্রী যখন অপকর্মের দায়ে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিলেন, তারপর সবাই নড়েচড়ে বসলেন। প্রশ্ন জাগে, ছাত্রলীগের নেতারা কী করছেন, সেটা কী তাদের দেখভাল যারা করে আসছিলেন তারা জানতেন না? যদি না জানবেন, তাহলে তারা প্রধানমন্ত্রী কিংবা আওয়ামী লীগ সভাপতির দেয়া দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন এটা মেনে নিতে হবে তাদের। কারণ, প্রভাবশালী নেতানেত্রীদের আশীর্বাদ না পেলে ছাত্রলীগ এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারতো না। এতবড় অপকর্ম করার দুঃসাহস দেখাতে পারতো না। ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরার কথা বহুবার বহুজন বহুভাবে বলেছেন। কিন্তু কে শুনেছেন কার কথা!
Advertisement
অবশেষে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন, অনেকেই এখন নড়েচড়ে বসেছেন। জোরেশোরে বলছেন; আওয়ামী রীগেরও অনেক নেতা নজদারিতে আছেন। সেটা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দুর্নীতি-অপকর্ম করে কেউ পার পাবেন না। তিনি যে দলেরই হোক না কেন। সভ্য, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় সেটাই হওয়া উচিৎ। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যখন খোদ প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন, তখন বিরোধী দল তাদের সেই পুরোনো ভাঙা ক্যাসেট বাজাতে শুরু করেছেন। 'সব দোষ আওয়ামী লীগের!’। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন তাদের সময় যে দুর্নীতি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে তারা কোন ব্যবস্থা নেননি। কোন উদ্যোগও নেননি। নিজেদের সেই ব্যর্থতার দায় তারা ঢাকবেন কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো উদ্যোগ নিয়েছেন। শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। সেটা নিজের দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। দেশের মানুষ সেই উদ্যোগকে স্বাগতই জানাচ্ছেন।
শেখ হাসিনার শুদ্ধি অভিযান মানে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ সত্যি হয়ে যাচ্ছে, যে সরকার শীর্ষ পর্যায় পযর্ন্ত আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্থ বিষয়টা মোটেও তা নয়। যদি তাই হতো তাহলে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে শুদ্ধি অভিযান চালাতে পারতেন না। তাছাড়া; আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে যারা ক্যাসিনো চালাচ্ছেন, অপকর্ম করছেন, টেন্ডারবাজি করছেন তাদের পুরনো ইুতিহাস খুঁজলে দেখা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই এক সময় আজকের বিরোধী দলের পৃষ্টপোষকতায় সেই দলটা করে এসেছেন। তাহলে কী বলতে হবে আসলে এই সব অপকর্মের হাতেখড়ি তাদের অন্যদলে? এরা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেন অপকর্ম আড়াল করার অস্ত্র হিসেবে। কিন্তু তারপরও একটা প্রশ্ন; হাঠৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিসক্রিয়তার প্রকট হয়ে ওঠার নমুনা আগে খুঁজে পাওয়া যায়নি কেন? তারা কেন এতোদিন নিষ্ক্রিয় ছিল?
বাংলাদেশের ক্লাব সংস্কৃতিতে প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল খেলাধুলা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই ক্লাব থেকে নিখাদ ক্রীড়া সংগঠকদের বেরিয়ে যেতে হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দাপটে। ধীরে ধীরে ক্লাবগুলো পরিণত হয়েছে রাজনীতির বলয়ে থাকা লোকজনের আখড়া হিসেবে। খেলা সেখানে গৌণ হয়ে গেছে। জুয়া, মদ, ক্যাসিনো পেয়েছে প্রাধান্য। যার ফল ক্রীড়াঙ্গনেও সাফল্যের ভাটার টান। নীতি-নৈতিকতাকে দূরে ঠেলে এগিয়ে যতে চাইছে আমাদের তরুণ সমাজ। এটি আগামী দিনের এক ভঙ্গুর, ভয়ঙ্কর সমাজের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যা দেশ-জাতি-সমাজ-রাজনীতি-ক্রীড়া-সংস্কৃতি কোন কিছুর জন্যই শুভ লক্ষণ নয়।
অশুভ-অস্থির এক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও মানুষকে স্বস্তি জোগাচ্ছে। আশা জাগাচ্ছে। ঘর থেকে, দল থেকে যে অভিযান শুরু, সেটা চলমান থাকবে সেই প্রত্যাশাটুকু করা বাড়াবাড়ি কিছু নয়। আমরা সুস্থ সমাজের বাসিন্দা হিসেবে বাঁচতে চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য আরো সুন্দর একটা সমাজ রেখে যেতে চাই।
Advertisement
লেখক : এডিটর দীপ্ত টিভি। সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর