বাসে চড়তে ভালো লাগে। বেশি মানুষ ভালো লাগে না। বাসে বেশি মানুষ থাকে। তাই বাস পছন্দের তালিকায় না থাকার কথা। তা হয় না কখনো। বরং বেশি মানুষ থাকে বলে বাস আরামদায়ক। বিশেষ করে লোকালবাস। ওখানে কথা শোনা যায় অনেক। শুরু হয় ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি। এক টাকা বা দুই টাকা কমানো। শেষটা গোষ্ঠি উদ্ধার দিয়ে। চালকের সহকারী উদ্ধার করে যাত্রীর। যাত্রী করে সহকারীর । যদি মারামারি পর্যন্ত গড়ায় ঘটনা, তবে সেখানে অনেক সমীকরণ পাওয়া যায়। অনেকেই সেই মারামারিতে অবদান রাখে। চুপচাপ মানুষটাও হুংকার দেয়, বাঘের। ঘুষি এবং থাবার পার্থক্য থাকে না। কেন?অনেক ভেবে দেখেছি, মনের ভেতরের ক্ষোভ থেকে এই কাজটি করে মানুষ। সহকারী হয়তো জনৈক এক্স এর কোনো ক্ষতি করলো না, তারপরো এক্স থেমে নেই। কিল ঘুষি চাপড় থাপ্পড় দিতে না পারলেও ফুঁস করে উঠবে। একটা অবদান রাখা চাই-ই চাই। শুরুতে হয়তো কোন এক যাত্রীর ক্ষোভ থাকে। সেই ক্ষোভ অন্যের ক্ষোভের সঙ্গে ঐক্যতান হয়। নিজের ক্ষোভের কথা মনে পড়ে। নিজের অপ্রাপ্তি মনে পড়ে। মনের ঝাল তখন মার খাওয়া লোকটার ওপর ঝরতে থাকে। ক্ষোভের এই সূত্র শুধু বাসে নয়, সমাজের অনেক আন্দোলনেই ঘটে। নিজের ব্যক্তিগত ক্ষোভ, সামাজিক বঞ্চনা, জীবনের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সবই আন্দোলনের নিয়ামক। তাহলে, কালিহাতির মানুষের ক্ষোভ কী,তাদের অনেক ভিন্ন ভিন্ন ক্ষোভের যোগফল? প্রশ্নটি জটিল। দামিও। মধ্যবিত্ত দান খয়রাত করে একটু বেশি। টাকার অংকে নয়, সামর্থ্যের বিচারে। গরীব দেখলে তার অনুকম্পা হয়। ভাবে, অবস্থা একটু খারাপ হলে সেও হতে পারে ফকির। অন্যের এক দরজা থেকে আরেক দরজা হতে পারে তার গন্তব্য। তাই সে দান করে। এই ব্যাখ্যার ভিন্ন কথাও আছে। ভয় পায় তাই দূর দুর করে। না জানি তার মতো হতে হয়। তাহলে, কেউ নির্যাতিত হলে তার পক্ষে কেন জনমত। ওই যে সে ও নির্যাতিত হতে পারে এই ভয়। কালিহাতির মিছিলে এই ভীত মানুষের সংখ্যা কত ছিলো?মা ও ছেলের চেয়ে নিবিড় সম্পর্ক আর কোনটা। একজনের শরীরের বিন্দু বিন্দু কণা দিয়ে আরেকজন গড়ে ওঠে। সবল হয়। শ্রদ্ধা শেখে। এই সম্পর্ক সামাজিকভাবে ভালো চোখে দেখা হয়। যখন সন্তানের সামনে মা অপমানিত হয়, তখন সন্তানের ক্ষোভ সবাই অনুমান করতে পারে। তার ক্ষোভ অন্যের মনে ছড়িয়ে পড়ে। নিজের অসংখ্য ক্ষোভের সঙ্গে মিতালি হয় তার। সমাজ ভেঙে পড়ার ভয় মানুষের মনে ঢুকে। সেই ভয় থেকে মানুষ নামতে পারে রাস্তায়। প্রতিবাদে। প্রতিবাদী মানুষের মনে সমাজ ভেঙে পড়ার ভয় কাজ করতে পারে। সেই প্রতিবাদ উস্কে দেয়া যায়। নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নানাভাবে ব্যবহার করা যায়। যারা মানুষকে দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নেয়, তারা এসব সমীকরণ ভালো জানে। তথ্য সেই সমীকরণে বাঁক বদল এনে দেয়। তথ্য আন্দোলনকে শেষ করে। আবার তথ্য আন্দোলনকে চাঙা করে। বলে রাখা ভালো, আন্দোলনের সময়ে গুজব একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তখন মানুষের মাথা এতো চড়া থাকে যে, তথ্য এবং গুজবের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। তাই ঠাণ্ডা মাথার মানুষটি নেতা হয়। তিনি সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে উত্তেজিত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তা না হলে কখনো কখনো এই জমায়েত সমাজের শান্তি ভেঙে দিতে পারে। কালিহাতির জমায়েত কী এমন এক সমাজ ভেঙে দেয়া সমাবেশ ছিল? দামি প্রশ্ন। তবে এর পেছনে অপরাধ টি, বা প্রতিবাদের কারণটি আর যাই হোক, সমাজের পক্ষে ভালো কোনো উদাহরণ নয়। মোটা দাগে একথা সবাই বলবে। তাহলে, পুলিশ কেন গুলি করলো? পুলিশ ভেবেছে এই জমায়েত শান্তি নষ্ট করবে। মানুষকে ছত্রভঙ্গ করতে দরকারে গুলি করার ক্ষমতা আইন তাদের দিয়েছে। ম্যাজিষ্ট্রেটের নির্দেশ মেনে তারা গুলি করতে পারে। তবে এখানেও কথা থাকে। ফাঁকা গুলি করে যদি জমায়েত ভেঙে দেয়া যায়, তাহলে ক্ষতি কেন? অন্যকোনোভাবে থামানো যেতো কী এই জনস্রোত? প্রশ্ন করার দরকার হতো না, যদি না জড়িত পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা না হতো। এখানে প্রত্যাহারের মানে কী তবে দোষ স্বীকার? কাজটি ভালো হয়নি, মেনে নেয়া। নাকি আরো জনরোষের আশঙ্কা করা। কাজগুলো ভালো নয়। অপমান করা। ছেলের সামনে মাকে। যারা এই কাজ করলো তারা আইন মানেনি। প্রতিবাদ হলো। পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে জনতার। গুলি। মানুষ মারা গেলো।গণমাধ্যমের কল্যাণে জানলেন সবাই। নতুন আরেকটি বর্বরতার সঙ্গে পরিচয় হলো। পিটিয়ে শিশু মারা, পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু মারাসহ নানা ঘটনা মানুষের মনে পড়লো। সভ্যতার দিকে, সুন্দরের দিকে যে যাত্রা, তাতে দেশের সব মানুষকে একসঙ্গে একই মিছিলে রাখা যাচ্ছে কি, এ প্রশ্ন সামনে আনা হলো। সুন্দর শান্তি উন্নয়নের পথের পাশেই ওরা এভাবে আদিম অন্ধকার কালো হয়ে থাকে পাশাপাশি। কালিহাতির কালি বোধহয় আমাদেরকে এ কথাই মনে করিয়ে দেয়। পুলিশ ও প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নির্যাতিতা নারীও মামলা করেছেন। আইন চলবে নিজের গতিতে। সবই হবে। তবে মনের ভেতর খচখচে একটা অনুভূতির জন্ম দিয়ে। সরকারের উচিত, এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া। পরে যেন এ ধরনের বা এর চেয়ে বর্বর কিছু হতে না পারে , তা দেখা। লেখক : সিনিয়র নিউজ এডিটর, দীপ্ত টিভি। এইচআর/এমএস
Advertisement