মতামত

ক্যাসিনো অ্যান্ড দ্যা সিটি

এ শহরে যাদের বাস, তাদের অনেকেরই মন এখন বড় আনচান। কেন দেখা হল না সেই বেদনায় তারা আচ্ছন্ন। এই ঢাকা শহরের বুকে লাস ভেগাস মানের ৬০টি ক্যাসিনো চলছে বহু বছর ধরে, অথচ শহরের বুকে জেগে থাকা এমন বিপজ্জনক ভালবাসার কথা এই বেদনাহত মানুষগুলো জানতেও পারলো না, যেমনটা পারেনি গণমাধ্যম। আর আমাদের সুরক্ষা বাহিনী? তারা হয়তো জেনেও জানেনি।

Advertisement

মুহূর্ত এগোয়। ফুটবল খেলার ক্লাবে কখন যে ফুটবলটাই গৌণ হয়ে গিয়ে জুয়ার আসর হয়ে গেল কে জানে। তাই ঢাকা শহরের মন কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা আলাদা করে প্রশ্ন করার দরকার নেই। আমরা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য উদ্যোক্তা পাইনা। কিন্তু ঝলমলে ক্যাসিনোর উদ্যোক্তা ঠিকই আছে। ফকিরের পুল ইয়ং ম্যান্স ক্লাবে যে বড় ক্যাসিনোটির সন্ধান পেল র‌্যাব সেটির উদ্যোক্তা শাসক দলের যুব সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ। মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া ক্লাবের ভেতর যে ক্যাসিনো সেখানে পরিচালক হিসেবে ছবি আছে যুবলীগের আরেক নেতা সম্রাট ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলম মুরাদের। অন্যগুলোও তাই।

কিন্তু প্রশ্নটিতো শুধু ক্যাসিনোর মালিকানা সংক্রান্ত নয়। প্রশ্নটা হল যারা জনগণের মঙ্গলের কথা বলে রাজনীতি করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে রাজনীতি করেন, তাদের অনেকেই সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করার এক খেলায় আছেন। যাদের জুয়া খেলতে গিয়ে আটক হয়েছেন, সাজা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে শহরের মানুষ আছে, আছে দূর দূরান্তের মানুষও। আছে নারীও। আজ আমরা জানতে পারলাম একটি নয়, দুটি নয়, এই শহরে শাসক দলের নেতাদের উদ্যোগ আর উদ্যমে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জুয়ার আসর।

পুলিশের নাগের ডগায়, নামকরা বাম রাজনীতিকের চেয়ারম্যানশিপে, প্রতিষ্ঠিত ক্লাবে কী ভাবে অবাধে ক্যাসিনো খুলে জুয়া চলে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শহরবাসী। বিশেষ করে যেখানে এগুলো পরিচালনায় আছে সরকারি দলের নেতারাই! পুলিশ জানত, ব্যবস্থা নেয়নি, কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে নির্দেশ পায়নি এতদিন। কিন্তু যুবলীগ চেয়ারম্যান যখন প্রশ্ন করেন – পুলিশ, র‌্যাব এতদিন আঙ্গুল চুষছিল, তখন তার দিকেও প্রশ্ন উচ্চারিত হতে পারে, তার সংগঠনের নেতারা যে এসব করছিলেন এতদিন, তিনি নিজে তাহলে এতদিন কি চুষছিলেন?

Advertisement

সুশাসন বা সুশীলদের ভাষায় ‘গুড গভর্নেন্স’ কাকে বলে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটার একটা সাহসী চর্চা হয়তো শুরু করেছেন। চাঁদাবাজির সংস্কৃতি বন্ধ করতে ছাত্রলীগের সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে দিতে না দিতেই যুবলীগের কিছু দানব নেতার ওপর তিনি চড়াও হয়েছেন। লক্ষণীয়, স্বাভাবিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে এসব চাঁদাবাজ আর অবৈধ ক্যাসিনো মালিককের পুলিশ গ্রেফতার করেনি বা করতে সাহস পায়নি পুলিশ। আর এ জন্যই প্রধানমন্ত্রীকে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কার্যনিবাহী সভা থেকে প্রকাশ্যে নিজের অভিপ্রায় প্রকাশ করতে হয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, সমাজের নানা পরিসরে অব্যবস্থাপনা বা অপশাসনের মূলে যে তার দলেরই চাঁদাবাজদের সদর্ভ পদচারণা সেটা আর গোপন নেই এখন।

এমন একটি অবস্থা কতটা কেমন সুশাসন সে নিয়ে অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশে এমন ঘটনা বিরল। একজন প্রধানমন্ত্রী, যিনি আবার শাসক দলেও প্রধান, তিনিই নিজ দল বা অঙ্গ সংগঠনের ভেতরে থাকা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বহুবার উচ্চারণ করেছেন, চাঁদাবাজদের দলে বরদাশত করা হবে না। কিন্তু ঠিকই প্রমাণিত হয়েছে যে, কাদেরের এসব কথা ছিল আসলে হাওয়াই হুমকি। দলের চাঁদাবাজরা অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছে, তাদের বাদ দিয়ে দলের আধিপত্য অচল। তাই ওবায়দুল কাদেরসহ প্রায় সব নেতাদের হুমকি বা ধমক তারা গায়ে মাখেনি।

শুধু ঢাকা নয়, গোটা দেশ, গ্রাম-গঞ্জসহ সর্বত্র ছাত্রলীগ আর যুবলীগ নামধারীদের দৌরাত্ম্য উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ছাত্রলীগ গত দশ বছরে কোন ভাল কাজে সংবাদ শিরোনাম হতে পারেনি, পারেনি যুবলীগও। খুন, সহিংসতা, চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণ বা সহিংসতা, যা-ই বলিনা কেন এরা আছে। ছাত্রলীগ নামধারীরা ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে, যুবলীগ পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলেছে চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। পুলিশ-প্রশাসনও এদের সুরক্ষা দিয়ে সমাজের মৌলিক কাঠামোটিকেই পরিবর্তিত করে চলেছে।

Advertisement

বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরাজমান তাতে সবাই জানে চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট শাসক দলের ছত্রচ্ছায়াতেই সব সময় পুষ্টিলাভ করে। এটা বিএনপি জমানাতেও সহজবোধ্য ছিল, এই জমানাতেও তা সহজবোধ্য। সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার কাউন্সিলরদের সাথে স্থানীয় দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ ও দুষ্কৃতীদের নিবিড় যোগাযোগ প্রকট। আর এ কারণেই আজ ছাত্রলীগ আর যুবলীগের বেপরোয়া অত্যাচারে জনসাধারণের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, র‌্যাব ক্যাসিনো বন্ধ করেছে। কিন্তু যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফরুক চৌধুরী যে হুংকার দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে তিনি সরকারকে, প্রধানমন্ত্রীকেই চ্যালেঞ্জ করছেন। অনেকেই মনে করতে পারেন, তিনিও যেন ক্যাসিনো পথের পথিক।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বা অভিপ্রায়ে যখন একটা শুদ্ধতার চেষ্টা হচ্ছে তখন ওমর ফারুক চৌধুরী, এর মাঝে বিরাজনীকিকরণের চক্রান্ত খুঁজে পেয়েছেন! প্রতিটি জনপদে, বস্তুত প্রতিটি মহল্লায় এমন অভিযোগ এখন বহুশ্রুত যে, চাঁদাবাজির বখরা কিংবা সরকারি-বেসরকারি বরাদ্দ কুক্ষিগত করার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দলে তীব্র গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। তার জেরে খুনোখুনিও চলছে।

দলের শীর্ষ নেত্রীর পক্ষে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দেওয়া কতটা সম্ভব তা বলা কঠিন। তবে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, সেটাকে সাধুবাদ জানাই। আশা করি সবাই বুঝতে পারবে - রাষ্ট্র কর্মে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়, পুলিশকে দলীয় পক্ষপাত ও আনুগত্যে নত করলে সুশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস