বিশেষ প্রতিবেদন

রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিকীকরণ করতে হবে শক্তভাবে

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ। সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হয়েছেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন এবং বাণিজ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ, ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, সুইডিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা, টেকসই উন্নয়ন কমিশন, অ্যাকশন এইড, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থার পরামর্শদাতা ছিলেন। সুশীল সমাজের নীতিনির্ধারকদেরও একজন তিনি।

Advertisement

ব্র্যাক প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। বলেন, ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিচক্ষণতার সঙ্গে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে ব্র্যাক।’

আলোচনায় ব্র্যাক নিয়ে নিজের ভাবনাও প্রকাশ করেন। বলেন, ‘আমি এবং ব্র্যাক যেন সমার্থক হয়ে না যায়।’ মতামত ব্যক্ত করেন রোহিঙ্গা ইস্যু এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গে। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : আগের পর্বে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান পদে আপনার যোগদান প্রসঙ্গে বলেছিলেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকে কীভাবে সম্পৃক্ত থাকছেন?

Advertisement

হোসেন জিল্লুর রহমান : আমরা বোর্ড মিটিংয়ের মাধ্যমেই স্যারের জন্য বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করে একটি পদ তৈরি করেছি। ‘ইমেরিটাস চেয়ার’ নামে নতুন একটি পদ তৈরি করে স্যারকে সেখানে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। স্যার যতটুকু সময় পাবেন, তার মধ্য থেকেই মনিটরিং করবেন, আমাদের পরামর্শ দেবেন। তবে স্যারের উপস্থিতি নিয়মিত নয়। মূলত স্যার ব্র্যাক নিয়ে বিশেষ স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) গ্রহণ করছেন এবং এজন্য স্যারের রিলাক্স দরকার বলে আমরা মনে করি। আমরা নিজেরাও স্যারকে বিশেষভাবে সহায়তা করতে প্রস্তুত।

জাগো নিউজ : ব্র্যাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত লাখো মানুষ। তাদের জন্য কী বার্তা দেবেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : প্রতিষ্ঠাতা একটি ভিত্তি তৈরি করে গেছেন। অনেকে মনে করেন প্রতিষ্ঠাতা না থাকলে ভিত্তি নড়বড়ে হতে পারে। কিন্তু ধারাবাহিকতায় যেন ছেদ না পড়ে, সেই বিষয়টি অনুভব করেই ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা তার বিচক্ষণতার মাধ্যমে ক্রমধারা তৈরি করেছেন। এ কারণেই মনে করি, মাঠপর্যায়ে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তি তাদের স্বাভাবিকতা প্রকাশ করবেন এবং কাজে আরও উদ্যমী হবেন বলে বিশ্বাস করি। নতুনভাবে পথ চলায় যে সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তার যেন আরও সদ্ব্যবহার হয়।

প্রতিষ্ঠাতা চলে যাওয়ার পর এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এখানে সেই ঝুঁকি একেবারেই নেই বললে চলে এবং এটিই হচ্ছে সবার জন্য মূল বার্তা। যারা যেভাবে জড়িত আছেন, তারা সেভাবেই কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন।

Advertisement

জাগো নিউজ : ব্র্যাকের পরিধি বাড়ছে। বাড়ছে ব্যবসার পরিধিও। এ নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান : ব্র্যাকের ব্যবসা বাড়ছে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের (সামাজিক উদ্যোগ) মাধ্যমে। যেমন- আড়ং, আড়ং দুধ, বীজ। এগুলো ব্যবসা বটে। তবে এসব পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের জন্য একটি বাজার তৈরি হয়েছে। সোশ্যাল বিজনেস বলে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে সম্প্রতি। অথচ, সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ তার পূর্ববর্তী ধারণা।

সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকতেই পারে। যেমন- ট্যাক্স দেবে, কি দেবে না। এখন কিন্তু ট্যাক্স দেয়া শুরু করেছে। সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ নিয়ে ব্র্যাকের আরও ভাবনার সময় এসেছে। আরও ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে বলে মনে করি।

সরকার সামাজিক নিরাপত্তার জন্য নানা সহায়তা দিচ্ছে। সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ঠিক তা নয়। এর অর্থ হচ্ছে, দারিদ্র্য মানুষদের বাজারে প্রবেশের বিশেষ সুযোগ করে দেয়া। যাদের বাজারে প্রবেশের ক্ষমতা অত্যন্ত কম। বাজারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা যেন ন্যায্যতার ভিত্তিতে অধিকার নিশ্চিত করতে পারে, সে প্রশ্ন সামনে রাখতেই হবে। ব্যবসার ধারণা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের ধারণার মধ্যে আনতে হবে।

দারিদ্র্য বিমোচনে দুই ধরনের বিষয় থাকে। প্রথমত, তাদের সরাসরি সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত, তাদের উৎপাদনমুখী করে বাজারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

জাগো নিউজ : ব্র্যাকের সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ নীতিতে এখন কর্পোরেট নীতি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। এর বিপরীতে কী বলবেন? যেমন- আড়ংয়ের পণ্যের মূল্য নিয়ে বিতর্ক উঠল…

হোসেন জিল্লুর রহমান : একটি ঘটনা দিয়ে সার্বিক বিষয়ে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। একজন গরিব মানুষের উৎপাদিত পণ্য দুভাবে বাজারমূল্য পায়। শহরের বেশি মূল্যের বাজার এবং গ্রামের অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের বাজার। প্রশ্ন হচ্ছে, তার অভাব দূরীকরণে কোনটিকে গুরুত্ব দেব। শহরের বাজারে প্রবেশ করতে পারলে অবশ্যই বেশি সুবিধা পাবে।

আমি মনে করি, মুনাফার জায়গাটা একটি সহনীয় মাত্রায় থাকা এবং তা বণ্টনে স্বচ্ছতা থাকা সময়ের দাবি। মূলত এখানেই হচ্ছে জবাবদিহিতা। সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের গুরুত্ব আগামী দিনে আরও বেশি এবং সে বিবেচনা থেকেই এগিয়ে আসতে হবে।

জাগো নিউজ : যেমন…

হোসেন জিল্লুর রহমান : মানুষ তাদের সন্তানদের ভালো স্কুলে দিতে চায় এবং সেটা গরিবরাও চায়। কিন্তু ভালো স্কুলের মাইনে একজন গরিব মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সহনীয় কম মূল্যে যদি তুলনামূলক একটি ভালো স্কুল তৈরি করা যায়, সেখানে অনেকেই আসবে। কিন্তু দরিদ্র বলে একেবারে বিনামূল্যে শিক্ষা দিলে স্কুলটি আর চলবেই না। স্কুলের খরচ কে চালাবে? আর এখানেই হচ্ছে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের ধারণা। যেমন- অতি উচ্চ মূল্যের আবাসন তৈরি করে ব্যবসা করা যায়। আবার অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের আবাসন তৈরি করে অধিক লোকের বাসস্থানের ব্যবস্থাও করা যায়। বৈষম্য নিরসনে কোনটি গুরুত্ব দেবেন সেটিই হচ্ছে বিবেচনার বিষয়।

কর্পোরেট নীতিতে অযৌক্তিক মুনাফার বিষয় গুরুত্ব পায়। কিন্তু বাজার সম্প্রসারণ করে যদি উৎপাদকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রাখবে। বাজার অর্থনীতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যদি তৃণমূল মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ করানো যায়, তাহলে একটি টেকসই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা শিবিরে ব্র্যাক বড় পরিসরে কাজ করছে। সেখানকার কর্মকাণ্ড কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : ব্র্যাকের যেহেতু এক ধরনের দক্ষতা আছে, সেহেতু সরকার ও দাতা সংস্থাগুলো ব্র্যাককে দ্রুত কাজে লাগাতে পেরেছে। মানবিক বিবেচনায় অর্থের যথাযথ ব্যবহার যেন নিশ্চিত করা যায়, সে ব্যাপারে সকলের নজর ছিল। ব্র্যাক সে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার স্বীকৃতি অর্জন করেছে নানাভাবেই।

ব্র্যাক মানবিক বিষয়ে সহায়তা করতে পারে কিন্তু রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক সমাধান দিতে পারে না। এটি করতেও পারে না। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার ভিত্তিতে ব্র্যাক সেখানে মানবিক বিষয়গুলো জোরালোভাবে দেখছে। যতদিন প্রয়োজন সে কার্যক্রম চালিয়ে যাবে ব্র্যাক।

জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিও কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেশ কয়েকটি এনজিওর ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে। এটি কীভাবে দেখছেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : এ প্রশ্নেও সরকারকে সুচিন্তিতভাবে এগোতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু হচ্ছে একাধারে মানবিক বিষয় এবং ভূ-রাজনৈতিক বিষয়।

আমাদের প্রথম দুর্বলতা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুটি শুধু মানবিকভাবে দেখেছি। ভূ-রাজনৈতিকভাবে না দেখলে এর যে টেকসই সমাধান হবে না, তা এখন বুঝতে পারছে সবাই। ভূ-রাজনৈতিক সমাধানে এনজিও কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে এনজিওগুলোকেও সচেতন থাকতে হবে।

মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চিরস্থায়ীভাবে থাকতে পারে না। সে সুযোগ নেই। নিপীড়িত হয়ে সাময়িকভাবে তারা আশ্রয় নিয়েছে। এক সময় তাদের ফিরে যেতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে জাতীয় ইস্যু না করে আন্তর্জাতিক ইস্যু করা জরুরি। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একত্রিত করে সমাধানের পথ বের করতে হবে। ঢালাওভাবে এনজিওগুলোকে দুষলে হবে না, আবার সরকারের যে ভূ-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে, তা এনজিওগুলোকে সচেতনভাবে বুঝতে হবে।

জাগো নিউজ : কিন্তু কিছু কিছু এনজিও বিতর্কিত ভূমিকা রাখছে, যা সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে…

হোসেন জিল্লুর রহমান : এটি তদন্ত-সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি রাখে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া ঢালাও দোষ দিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। নিজেরা যদি এমন বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করি তাহলে মিয়ানমার আরও উৎসাহিত হবে। এ কারণেই আমি মনে করি, মানবিকতার পাশাপাশি আগে থেকেই ভূ-রাজনৈতিক বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেয়ার দরকার ছিল।

জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোথায়?

হোসেন জিল্লুর রহমান : সকল বিভেদ ভুলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিকীকরণ করতে হবে শক্তভাবে। তাহলেই সমাধানের পথ বের হবে। নিজেরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং লাভবান হবে মিয়ানমার। দুই বড় দেশ ভারত ও চীনকে বাগে আনতে হবে এর সমাধানে।

এএসএস/এমএআর/জেআইএম