মতামত

দ্বিতীয় গণভোটই কি ব্রেক্সিট জঞ্জালের বিকল্প?

আমেরিকার উপগ্রহ বলা চলে ব্রিটেনকে। সব কাজ-অকাজে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে আছে যুক্তরাজ্য। শুধু তাই নয় যুক্তরাজ্যের মানুষ এবার আমেরিকার মতই একজন সরকার প্রধান খুঁজে পেয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন চলনে-বলনে পুরাই ডোনাল্ড ট্রাম্প। চেহারাতেও ট্রাম্পের কাজিন-ব্রাদার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের পৃথকীকরণ বা ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটেনে এ পর্যন্ত দুইজন প্রধানমন্ত্রী বিদায় নিয়েছেন। এখন তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দৃশ্যে আছেন। মনে হচ্ছে তিনিও কাজের কাজ কিছুই করতে পারবেন না। মাঝখানে জল ঘোলা করে যাচ্ছেন।

Advertisement

ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকার পক্ষে-বিপক্ষে কোনো আন্দোলন ছিল না যুক্তরাজ্যে। শুধু বৈঠকী আলোচনার সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইউনিয়নে থাকা না থাকার প্রশ্নে গণভোট দিয়ে বসলেন। সামান্য ভোটের ব্যবধানে যুক্তরাজ্যের মানুষ ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষে রায় দিল। ক্যামেরন ইউনিয়নে থাকার পক্ষের লোক ছিলেন এবং তিনি গণভোটের আগেই ইউনিয়নে থাকার পক্ষে প্রচার প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। গণভোটে পরাজয়ের পর তিনি আর ক্ষমতায় থাকেন কিভাবে। অবশেষে তিনি পদত্যাগ করে চলে গিয়েছেন।

ক্যামেরনের পরে থেরেসা মে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলেন। দুই বছর প্রাণপণ চেষ্টা করেও ইউনিয়ন পক্ষ এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সন্তুষ্ট হয়, উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়- এমন কোনও চুক্তির খসড়া তিনি প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হন। অবশেষে কেঁদে কেটে থেরেসা মেও পদত্যাগ করে চলে যান।

সামান্য ব্যবধান হলেও, কেন যুক্তরাজ্যের লোক ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করতে গণভোটে রায় দিলো বলা দরকার। মোদ্দা কারণ ছিল ইউনিয়নভুক্ত পূর্ব ইউরোপের বহু ছোট ছোট রাষ্ট্রের লোকজন চাকরি-বাকরির সন্ধানে যুক্তরাজ্যে গিয়ে বসতি স্থাপন করছে এবং তাদের ছেলে মেয়ে যুক্তরাজ্যের স্কুল কলেজে লেখাপড়া করছে। যুক্তরাজ্যের লোকের দৃষ্টিতে তারা আনকালচার্ড। তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে ইংরেজ জাতির ছেলে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজের পরিবেশ নাকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলংকার মানুষে বোঝাই সমগ্র যুক্তরাজ্য। এমনকি লন্ডন শহরের মেয়র পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান, তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।

Advertisement

ইন্ডিয়ান খানা খেতে তাদের উৎসাহের অন্ত নেই। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ক্যামেরন একবার আমাদের সিলেটের মেয়ে ব্রিটিশ এমপি রোশনারাকে বলেছিলেন- এমন সময় আসছে যুক্তরাজ্যে তোমরাই প্রধানমন্ত্রী হবে। যাহোক, নতুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ইউনিয়ন ত্যাগ করতে পারবেন কিনা এখন সেটাই বড় প্রশ্ন? প্রধানমন্ত্রী হয়ে বরিস বলেছিলেন প্রয়োজনে তিনি চুক্তি ছাড়াই ইউনিয়ন ত্যাগ করবেন। কিন্তু তার সেই আশা এখন পূরণ হওয়ার নয় কারণ বিরোধীরা পার্লামেন্টে বিল এনে আইন পাস করেছে- চুক্তি ছাড়া ইউনিয়ন ত্যাগ করা যাবে না।

বিরোধীদের সঙ্গে সরকারি রক্ষণশীল দলের ২১ জন নামিদামি পার্লামেন্ট মেম্বার হাত মিলিয়েছেন। তারা চেষ্টা চালালে আরো কয়েকজন সদস্য তাদের পক্ষে আনতে পারেন। এই ২১ জন সদস্যের মধ্যে রয়েছেন সাবেক চ্যান্সেলর অফ এক্সচেকার ফিলিপ হ্যামন্ড, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের পৌত্র স্যার নিকোলাস স্মস এবং সিনিয়র সদস্য কেন ক্লার্ক, প্রমুখ।

বরিস জনসনের এটা হচ্ছে চরম পরাজয়। চুক্তি ছাড়া বের হয়ে যাওয়ার পথ অবরুদ্ধ হয়ে গেল তার জন্য। এর মাঝে বরিস জনসন একটা ওভারস্মার্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি রাণীকে বলে-কয়ে গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে পাঁচ সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করে দিয়েছেন। এমন কাজ অশাসনতান্ত্রিক না হলেও বিরোধী লেবার পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেট এবং স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টিসহ তার কনজারভেটিভ পার্টি তীব্র সমালোচনা করেছে।

ওয়েস্টমিনিস্টার পার্লামেন্টের স্পিকার জন বারকো বলেছেন এই উদ্যোগ পার্লামেন্ট সদস্যদের অধিকারের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। অনেকে অভিযোগ করেছেন বরিস জনসন রাণীকে মিথ্যা বলে পার্লামেন্ট স্থগিত করেছেন। জনসন কিছু জটিলতা থেকে পরিত্রাণের আশায় আইরিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছেন। ফন্দি ফিকির করে চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট কার্যকর করতে চাইলে বরিস জনসন জেলে যাবেন। আসলে ব্রেক্সিট ব্রিটিশ রাজনীতিকে চরম এক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জনসন হতাশ হয়ে বলেছেন যে তার নাকি খাদে পড়ে মরতে ইচ্ছে হচ্ছে।

Advertisement

বিবিসির ভাষ্যমতে জনসনের হাতে মূলত চারটি বিকল্প উপায় রয়েছে, এর যেকোন একটিকে তার বেছে নিতে হবে। এক. আইন অমান্য করে ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে ইইউ ত্যাগ করা। জনসন নিজে সব সময় বলে এসেছেন, ৩১ শে অক্টোবরের মধ্যেই ব্রেক্সিট হবে। তবে তিনি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে, এমন হুঁশিয়ারিও তাকে দেয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় পথ হচ্ছে, দ্রুত একটি নতুন চুক্তি করা। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, পার্লামেন্ট বন্ধ থাকার সময়টিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর কাজে ব্যবহার করবে সরকার। একই সঙ্গে চুক্তি ছাড়া ইইউ ত্যাগের বিষয়েও প্রস্তুতি নেয়া হবে। তবে ইইউ মনে করে, একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য ব্রিটিশ সরকারের তেমন কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

তিন নম্বর পন্থায় বলা হচ্ছে, ১৯ অক্টোবরের মধ্যে এমপিরা চুক্তিসমেত অথবা চুক্তিহীন ব্রেক্সিটে সম্মতি না দিলে, প্রধানমন্ত্রীকে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্রেক্সিট পেছানোর জন্য সময় চাইতে হবে। তাতে তার কিছুটা মানহানি হলেও তাৎক্ষণিক সংকট কাটবে। এরপরে নভেম্বর বা ডিসেম্বরের দিকে তিনি নির্বাচন দিতে পারবেন এবং প্রচারণা চালাতে পারবেন যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই তিনি নিয়েছেন। এতে করে দলের মধ্যে নিজের সমর্থন বাড়ানোর জন্যও সময় হাতে পাবেন তিনি।

চার নম্বর উপায় হচ্ছে ‘অন্য কেউ চাইলে সময় বাড়াক, আমি সময় বাড়াতে চাইবো না’ বলে পদত্যাগ করা। জনসন পদত্যাগ করলে, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী যিনি হবেন হাউজ অব কমন্সের মাধ্যমে ইইউ এর কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন জানানোর জন্য ১৪দিন সময় হাতে পাবেন। এমনিতে এখন কনজারভেটিভ পার্টি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।

তবে আমার মনে হচ্ছে সব কিছু ছাড়িয়ে ব্রিটিশ জাতি যদি দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলা এই বেক্সিট জঞ্জাল থেকে পরিত্রাণ চায় তবে নতুন এক গণভোট ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। ব্রেক্সিট কার্যকর হলে যুক্তরাজ্য ভেঙেও যেতে পারে। স্কটল্যান্ড হুমকি দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে না থাকলে তারাও যুক্তরাজ্য ত্যাগ করতে পারে। কারণ তারা ইউনিয়নের সঙ্গে থাকতে আগ্রহী। কয়েক বছর আগে স্কটল্যান্ড ব্রিটেন থেকে পৃথক হবে কিনা এই প্রশ্নে গণভোট হয়েছিল। তাতে কিন্তু অতি সামান্য ভোটে হেরে গিয়েছিল স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী নেতারা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com

এইচআর/পিআর