মতামত

আমরা কি উদার না স্বার্থপর?

আমাদের এই সবুজ-শ্যামল সোনার দেশটার ভাল-মন্দ সবকিছুতেই আমরা দ্বারস্থ হই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটে যাতে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ই কথা বলতে হয়। চারপাশের প্রতিনিয়ত নানা নেতিবাচক খবরে ত্যক্ত-বিরক্ত জনসাধারণ বলতেই পারেন - "হে মুগ্ধ জননী, সাত কোটি বাঙালিরে রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করনি।"

Advertisement

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে স্বাধীন বাংলাভূমিতে দলীয় নেতাকর্মী আর জনগণকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। সেসময় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, দেখুন কবিগুরু, আমার সাত কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। সত্যিই তখন মানুষ ছিল স্বাধীন বাংলার জনগণ।

কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে দাঁড়িয়ে, ছয় হাজার টাকার একটি বালিশ, ৩৭ লাখ টাকার পর্দা আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জন্য ৭৪৯ ধরনের ছয় হাজারেরও কিছু বেশি বইয়ের জন্য দুই কোটির ওপরে যখন বাজেট হয়, তখন কেবলই মনে হয় এই বাঙালিই কি সেই ১৯৭১ এর বীর বাঙালির উত্তরসূরি? স্বাধিকার আর স্বাধীনতার লড়াইয়ে যে বাঙালি জীবন পণ করে অর্জন করেছিলো মুক্তি। উন্মুক্ত আকাশে উড়িয়ে ছিল লাল-সবুজের পতাকা। সত্যিই দেশাত্মবোধের অনন্য নিদর্শন এই বাঙালি আজ কি কেবলই লোভী, আত্মস্বার্থান্ধ!! আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, দেখে যাও বঙ্গবন্ধু... তোমার সোনার বাংলা আজ লোভী, দেশপ্রেমহীন নির্লজ্জ হচ্ছে কিভাবে!!!! কারা এই বাংলাভূমিকে নিঃস্ব, রিক্ত করছে, শুষে নিচ্ছে তার রূপ-রস আর সম্পদ??

সম্প্রতি আরো অবাক হই, যখন খবরে উঠে আসে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশ পাড়ি জমায় আমাদেরই আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। অবাক হই এইজন্য যে, দেশের সাধারণ মানুষ পাসপোর্ট করতে কত কাঠ-খড় পোড়ান, অথচ নাগরিকত্বহারা রোহিঙ্গারা কত অনায়াসেই পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পাসপোর্ট। এই বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে তারা পাড়ি জমাচ্ছে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। প্রশ্ন হলো কিভাবে সম্ভব রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট?

Advertisement

একটি পাসপোর্টের জন্য জন্ম সনদসহ কত কি প্রয়োজন হয়। রোহিঙ্গাদের কি এতসব কাগজপত্র লাগে না। নাকি বাঙালি এতো লোভাতুর যে, টাকা দিয়েই সব কাগজপত্র তুলে দিচ্ছে বাংলাদেশে জামাই আদরে থাকা রোহিঙ্গাদের হাতে। একটু দেশাত্মবোধ নেই কেন আমাদের মাঝে, কেন এতো লোভী হয়ে উঠি আমরা? নিজ স্বার্থ উদ্ধারে সমষ্টির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে কিংবা দেশ বিকিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হই না কেন?

সেই ২০১৬ সালের আগস্টে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গারা। তখন থেকেই আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে নানা কৌশলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় তারা। ইয়াবাসহ নানা মাদক ব্যবসা এবং অনৈতিক কাজেও জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের বেশ সংখ্যক। চলে বাংলাদেশ দিয়ে অন্য দেশে যাওয়ারও নানা পাঁয়তারা। ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারিতেই চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ২২ জনকে আটক করেছিলো ইমিগ্রেশন পুলিশ। তারা জাল পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। যদিও তদন্ত সাপেক্ষে ১৪ জনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাস। অভিযোগ আছে, বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছেন ও নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন। দালালদের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে ফেলছেন শরণার্থী শিবিরের কিছু রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশিরাই এনআইডি বানাতে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করছে। এ অপরাধে অনেককে আটকও করা হয়েছে। জানা গেছে, এনআইডি ছাড়াও পাসপোর্টও তৈরি করে শত শত রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এমনকি মিয়ানমার থাকতেই অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্টের মালিক হয়েছে বলেও সত্যতা পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালের আগস্টের পরে নতুন করে অনুপ্রবেশকারীরা দালালদের মাধ্যমে এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরি করে ফেলেছে। তারা চেষ্টা করছে বিদেশে পাড়ি দেয়ার। রোহিঙ্গাদের এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে তাদের প্রবাসী স্বজনরা ও বাংলাদেশি অভিবাসী দালালরা।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চিন্তিত প্রশাসনও। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনও বলেছে, রোহিঙ্গারা যাতে জাল পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে না পারে, সেই বিষয়টি নজরদারীতে রাখা হয়েছে। এদিকে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেয়ার কারণে জনশক্তি রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে দাবি করে আসছে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা। বাংলাদেশি পাসপোর্ট কী করে রোহিঙ্গাদের হাতে যাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলো সংগঠনটিও।

Advertisement

আমরা দেখেছি নির্বাচন কমিশনও বলছে, রোহিঙ্গাদের এনআইডি প্রাপ্তির বিষয়টি কঠোর নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। আর তাদের ভোটার আইডি প্রাপ্তির বিষয়েও রয়েছে ব্যাপক সতর্কতা। মিয়ানমার থেকে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাড়ে ১০ লাখের ফিঙ্গার প্রিন্ট ও আইরিশ সার্ভারে সংরক্ষিত আছে। ফলে তারা চাইলেও ভোটার তালিকায় প্রবেশ করতে পারবেন না। তাহলে স্বভাবতই আবারও প্রশ্ন জাগে, এতো সব সতর্কতা এড়িয়ে এখনও কিভাবে তাদের হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট যাচ্ছে?

সম্প্রতি কয়েকটি স্থানে কিছু রোহিঙ্গা এনআইডিসহ ধরাও পড়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদের কাছেও পাওয়া গেছে বাংলাদেশের পরিচয়পত্র (স্মার্ট কার্ড)। এ ঘটনার পর দেশজুড়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। সর্বশেষ চট্টগ্রামে দুইজন রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার বিষয়টি আমলে নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। তদন্ত করছে তিনটি কমিটি। খোদ নির্বাচন কমিশনই বলছে, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জড়িত। কারণ তাদের মাধ্যমেই নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে ইসি।

ইদানিং প্রশাসনের তৎপরতায় সতর্ক হয়েছে রোহিঙ্গারাও। পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র বানানোর ক্ষেত্রে তারা এখন আর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ঠিকানা ব্যবহার করছে না। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমেই জানা গেছে, গত দেড় বছরে বিভিন্ন দাতা দেশের সহায়তায় অন্তত এক হাজার তিনশ' রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ বেশকয়েকটি ইউরোপীয় দেশে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এসব পুনর্বাসিত রোহিঙ্গার পাঠানো অর্থে তাদের নিকটাত্মীয়রা স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ফি দিয়ে হজ ও ওমরাহ হজের নামে সৌদি আরবে চলে যাচ্ছে।

বিদেশে অবস্থান করলেও এখানে শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআর প্রদত্ত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা তাদের পরিবারের অন্যরা ভোগ করছে বলেও জানান তিনি। আরো জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ার নিবন্ধিত (পুরনো) রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অধিকাংশই বাংলাদেশি এনআইডি কার্ডধারী হয়ে গেছে, অনেকে পাসপোর্টও করে ফেলেছে। ১৯৯২ থেকে শরণার্থী হিসেবে অবস্থানের সুযোগে বাংলাদেশের সর্বত্র তাদের চেনা-জানা। অনেকের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনসহ কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবানসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে নানাভাবে সামাজিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। রেজিস্টার্ড ক্যাম্প দু'টোর শত শত রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অবস্থান করছে ও ক্যাম্পে যাতায়াত করছে।

এতসব তথ্য এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় উঠে আসছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে না, রোহিঙ্গাদের এতোসব সুবিধাদি পাওয়ার উৎসটা কোথায়? কোথায় আমাদের প্রশাসনিক নজরদারী? আশ্রিতদের এত সহজ, অবাধ বিচরণ কিভাবে সম্ভব। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের স্থানীয় জনগণ অনেকটাই অতিষ্ট। তাদের অনেকেরই এখন মনে হচ্ছে এতো মানবিক হয়ে আমাদের লাভটা কি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের থাকতে দিয়েছি, আমাদের উজাড় হলো বন, নষ্ট হয়েছে ক্ষেতের ফসল। রোহিঙ্গাদের অনাহারী মুখে খাবার তুলে দিয়েছি, তারা আমাদের সন্তানদের মাদক নেশায় আচ্ছন্ন করতে মরিয়া। তার উপর তো চুরি, ছিনতাই, মারামারির নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেছে। ক্যাম্পের ভেতরে যেমন তারা এগুলো করছে, তেমনি স্থানীয় জনগণের উপরও চড়াও হচ্ছে সময়-অসময়ে।

তাহলে আবারও প্রশ্ন- কেন আমরা এতো উদার? শুধুই কি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাকি তারা টাকা-পয়সা ছিটিয়ে কাক ডাকার মতো আমাদেরই কতিপয় ভাই-বন্ধু-স্বজনকে কুক্ষিগত করেছে? যদি তাই হয়, তাহলে কে বা কারা রোহিঙ্গাদের এরকম মদদদাতা বা পৃষ্ঠপোষক? ১৩ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিচ্ছে, তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই বিচারের আওতায় আনা হবে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী। সাধারণ মানুষও দেখতে চান আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হাতে যারা দেশের পরিচয় তুলে দিচ্ছে, সেই স্বার্থপরগুলো কারা?

লেখক : সাংবাদিক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর