মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সরবরাহ করা হয়েছে চট্টগ্রাম থেকেই। এক্ষেত্রে পুরো বিষয়টি ঘটেছে তিনজনের হাত ধরে। যারা বিভিন্ন সময় জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল।
Advertisement
তারা হলো- চট্টগ্রাম নগরের ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদীন (৩৫), নির্বাচন কমিশনের সাবেক দুই কর্মচারী সাগর (৩৭)ও সত্যসুন্দর দে (৩৮)।
এদের মধ্যে জয়নাল চট্টগ্রামে বসে থানা নির্বাচন অফিসের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরির প্রাথমিক কাজ করত।
বর্তমানে বিআরটিএতে কর্মরত সাগর এক সময় এনআইডি সার্ভারে আপলোড করত। সেই সুবাদে দেশের সব উপজেলার এনআইডি আপলোডের পাসওয়ার্ড তার কাছে আছে বলে জানা গেছে।
Advertisement
এছাড়া এনআইডি সার্ভারে অনুপ্রবেশের দায়ে তাকে নির্বাচন কমিশন থেকে চাকরিচ্যুত সত্যসুন্দর এখনো বিভিন্ন উপজেলায় এনআইডির ডাটা এন্ট্রির কাজ করে চলেছে।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন জাগো নিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বানাতে এ চক্রটি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিত। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের এনআইডির জন্য চট্টগ্রামে থেকে ছবি, আঙুলের ছাপসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদীন সরবরাহ করত। এক্ষেত্রে সে ছুটির দিনে অফিস থেকে নিয়ে আসা ওয়েবক্যাম, ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার যন্ত্র, স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাড বাসায় ব্যবহার করত।
এছাড়া নিজের কাছে থাকা উপজেলার এনআইডি আপলোডের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশনের সেন্ট্রাল সার্ভারে ডাটা ইনপুট দিত সাগর। একই কায়দায় জয়নালের সরবরাহ করা তথ্যে নির্বাচন কমিশনের সেন্ট্রাল সার্ভারে প্রবেশ করে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি হতো বলেন (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেয়ার এই চক্রের সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত আছে বলে আশঙ্কা করছি। সাগর ও সত্যসুন্দরকে গ্রেফতার করা গেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
Advertisement
এর আগে সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেয়ার ঘটনায় একই দিন রাতে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের এক কর্মচারীসহ পাঁচজনকে আসামি করে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় মামলা করা হয়েছে। নগরের ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা বাদী মামলাটি করেন।
মামলায় জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেয়া, দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করাসহ বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসামিরা হলেন- চট্টগ্রাম নগরের ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদীন (৩৫), তার সহযোগী পটিয়া উপজেলার মৃত হারাধন দাসের ছেলে গাড়িচালক বিজয় দাস (২৬) ও তার বোন সীমা দাস ওরফে সুমাইয়া (২৪)।
এর মধ্যে সীমা চট্টগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আয়া পদে কর্মরত। বাকি দুই আসামি হলেন- জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরির প্রজেক্ট থেকে সাবেক ইসি কর্মচারি সাগর (৩৭) ও সত্যসুন্দর দে (৩৬)।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান জাগো নিউজকে জানান, হাটহাজারী থেকে জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে আসা রোহিঙ্গা নারী লাকি আক্তারকে শনাক্তের পর জানা যায়, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের কেউ কেউ এর সঙ্গে জড়িত আছে। পরে ১১ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা অভিযানে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে সাতজনকে আটক করা হয়।
তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাতে ডাবলমুরিং থানার অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনকে আটক করা হয়েছে। পরে তার সহায়তায় বিজয় দাস ও তার বোন সীমা দাসকেও আটক করা হয়। এ সময় জয়নাল আবেদীনের হেফাজতে থাকা নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্স করা একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। ওই ল্যাপটপে আরো ৫১ জন রোহিঙ্গার তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য ইনপুট করার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ দুটি ল্যাপটপ গায়েব হয়। এর মধ্যে একটি (আইপি নম্বর ৪৩৯১) চট্টগ্রাম ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড তৈরি করা হয়েছে বলে ধারণা তদন্ত কর্মকর্তাদের।
গতকাল জয়নাল আবেদীনের সহযোগী বিজয় দাসের বোন সীমা দাস ওরফে সুমাইয়া থেকে ল্যাপটপটি উদ্ধার করা হয়েছে। যেটি জয়নাল কয়েক বছর আগে এই চক্রের মূল হোতা সাগর থেকে ১০ হাজার টাকায় ক্রয় করেছিল।
এমআরএম