আগ্রাসী ঋণ ঠেকাতে ঋণ-আমানত অনুপাত সীমা (এডিআর) কমিয়ে নতুন সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের জানুয়ারিতে জারি করা এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে টানা চারবার সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো হয়। কিন্তু তারপরও বাস্তবায়ন হয়নি। এখন প্রভাবশালীদের চাপে এডিআর বাড়িয়ে আগের অনুপাতে নিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
Advertisement
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব সাইট সুপারভিশন থেকে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করে দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে প্রচলিত ব্যাংকগুলো এতদিন ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা ঋণ বিতরণ করতে পারতো। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী এখন ঋণ বিতরণ করতে পারবে ৮৫ টাকা। ইসলামী ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করতে পারবে ৯০ টাকা। এতদিন ইসলামী ব্যাংকগুলো ৮৯ টাকা ঋণ দিতে পারতো।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর দ্বি-সাপ্তাহিক গড় ভিত্তিতে রক্ষিতব্য সিআআর এবং দৈনিক ভিত্তিতে রক্ষিতব্য এসএলআর বাদে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল দাঁড়ায় ৮১.৫০ শতাংশ এবং ইসলামি শরীয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য তা দাঁড়ায় ৮৯ শতাংশ। তবে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তি, তারল্য পরিস্থিতি, আন্তঃব্যাংক নির্ভরশীলতা এবং সর্বোপরি ব্যাসেল-৩ অনুসারে এলসিআর ও এনএসএফআরের নির্ধারিত মাত্রা সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত প্রচলিত ধারার ব্যাংকের জন্য অগ্রিম-আমানত হার (এডিআর) সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ (৮১.৫ শতাংশ + সার্বিক আর্থিক সূচকগুলো বিবেচনায় ব্যাংকের পর্ষদের সিদ্ধান্তক্রমে অতিরিক্ত ৩.৫ শতাংশ) এবং ইসলামি শরীয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংক এবং প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য বিনিয়োগ-আমানত হার (আইডিআর) সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ (৮৯ শতাংশ + সার্বিক আর্থিক সূচকগুলো বিবেচনায় ব্যাংকের পর্ষদের সিদ্ধান্তক্রমে অতিরিক্ত ১ শতাংশ) নির্ধারণ করা হলো।
Advertisement
অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংকগুলো ৮৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর অনুমোদিত সীমা ৯০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে এদিকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই আগ্রাসীভাবে ও মানহীন ঋণ বিতরণ ঠেকাতে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথম দফা এডিআর কমানোর ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন বলা হয়, জুনের মধ্যে বাংকগুলোকে বাড়তি ঋণ সমন্বয় করে নির্ধারিত সীমায় আনতে হবে। পরে ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি নির্দেশনা দিয়ে সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর করা হয়। এরপর তৃতীয় দফা সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ন্বয়ের সময় বেধে দেয়। আমানত কমে যাওয়াসহ নানা করণে ব্যাংকগুলোর এটি বাড়ানোর দাবি করে। পরে আবার এই সময় ছয় মাস বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ সমন্বয়ে সময় বাড়ানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে সীমার ওপরে ছিল ১৯ ব্যাংকের এডিআর। ঋণ আমানত অনুপাতে বর্তমানে সবার ওপরে রয়েছে ফারমার্স থেকে পদ্মায় রূপান্তরিত ব্যাংক। ব্যাংকটির এডিআর গত ডিসেম্বরের ১১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে উঠেছে। পর্যায়ক্রমে বেসিক ব্যাংকের এডিআর রয়েছে ১১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ, রাকাবের ১০৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯৫ দশমিক ৮১ শতাংশ ও এবি ব্যাংকের ৯৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সীমার ওপরে আরও রয়েছে এনআরবি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, মিডল্যান্ড, এনআরবি গ্লোবাল, আইএফআইসি, ট্রাস্ট, এনআরবি কমার্শিয়াল ও সিটি ব্যাংক।
ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে এসআইবিএল, এক্সিম, ইউনিয়ন, ফার্স্ট সিকিউরিটি এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের এডিআর রয়েছে সীমার বেশি।
Advertisement
এদিকে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে জুলাই মাসে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ হার ২০১৩ সালের জুনের পর সর্বনিম্ন। ওই সমেয় ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। আগের মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে। এ ছাড়া চলতি বছরের জুনের মাসের তুলনায় জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণ না বেড়ে উল্টো কমে গেছে।
ব্যাংকের তারল্য সংকট, ঋণ কাঙ্ক্ষিত বাড়ছে না বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাংকগুলোর কাছে এখন পর্যাপ্ত নগদ অর্থ নেই। ঋণ আমানত অনুপাতের (এডিআর) সমন্বয়ের চাপ রয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক খাতের নানা কেলেঙ্কারি ও সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি হওয়ায় ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ফলে একদিকে চাহিদা থাকা সত্তেও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে বেসরকারি খাতের ঋণ হুহু করে বাড়ছিল। ফলে ঋণ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে গত বছরের শুরুতেই ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার পর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। এরপর কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও নানা কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। নিম্নমুখীর ধারা অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জুনের তুলনায় চলতি বছরের (২০১৯) জুলাই শেষে সরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর আগের মাস জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।
এদিকে জুলাই মাস শেষে বেসরকারি খাতে বিতরণ করা ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময় শেষে ঋণ ছিল ৯ লাখ ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে ঋণ বেড়েছে এক লাখ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুনের মাসের তুলনায় জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণ না বেড়ে উল্টো কমে গেছে। গত জুন মাসে ঋণস্থিতি ছিল ১০ লাখ ১০ হাজার ২৫৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ঋণ কমেছে ৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।
এসআই/জেডএ/এমএস