টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত তিনজনের বাড়িতে চলছে কান্নার রোল। তবে এ ঘটনায় এখনো ওই এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কালিহাতী উপজেলার বিভিন্নস্থানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।এ ঘটনায় ৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ।শনিবার সকালে কালিহাতী পৌর এলাকার নিহত ফারুকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ফারুকের বড় ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী আসিফকে (৮) নিয়ে আহাজারি করে যাচ্ছেন মা শ্যামলা বেগম। পাশেই তিন বছরের ছোট মেয়ে ফাতেমাকে নিয়ে বাকরুদ্ধ ফারুকের স্ত্রী আসিয়া বেগম। ভ্যানচালক ফারুক ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। একই আহাজারি দেখা গেছে ঘাটাইল উপজেলার কালিয়া গ্রামের শামীম মিয়ার (৩৫) বাড়িতে। ঘটনার দিন জুমার নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন শামীম। কিন্তু নামাজ শেষে আর তার বাড়ি ফেরা হয়নি। আসন্ন ঈদের পরে তার সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল । এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা জমা দিয়েছেন তিনি। শামীম মিয়া হত্যার বিচার চান তার মা আমেনা খাতুন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার ছেলে তো মিছিল মিটিংয়ে যায়নি। তবে কেন তাকে পুলিশ গুলি করলো। তার দুটি ছোট ছোট ছেলে রয়েছে। এই সন্তানগুলোকে এখন কে বড় করবে ? কে আমাদের পরিবারের জন্য রোজগার করবে ? এদিকে স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন স্ত্রী বিথি। আদরের দুই সন্তান বাদল (৮) ও দেড় বছরের মীনকে নিয়ে স্বামীর লাশের পথ চেয়ে আছেন তিনি।এলাকাবাসী জানায়, এলাকায় শামীম পরিচিত ছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদকারী যুবক হিসেবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা তার স্বভাবসুলভ আচরণ ছিল। তাকে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের উপযুক্ত বিচার দাবি করেন এলাকাবাসী। একই অবস্থা আরেক নিহত কালিহাতী উপজেলার সালেঙ্গা গ্রামের শ্যামল দাশের বাড়িতে। স্থানীয় একটি সেলুনের কর্মী শ্যামল সেদিন গিয়েছিলেন শ্লীলতাহানির ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুত্রশোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন বাবা রবি দাশ। আপনজনদের ধরে বিলাপ করছেন মা ভারতী রানী। তিন ভাইয়ের মধ্যে শ্যামল ছিলেন সবার বড়। এই পরিবারের স্বজন হারানোর বিচার দাবি করেছে এলাকাবাসী।এদিকে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন জানান, এ ঘটনায় প্রাথমিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিহত প্রত্যেকটি পরিবারের মাঝে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হবে। ময়নাতদন্তের পর লাশ পরিবারের মাঝে হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক। শুক্রবার সন্ধ্যা পৌঁনে ৬টার দিকে ঘাটাইল উপজেলার আঠারদানা ও হামিদপুর এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কালিহাতী থানা ঘেড়াওয়ের উদ্দেশ্যে কলেজগেট এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এসময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের উপর ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এতে কালিহাতী থানা পুলিশের এসআই ফারুক, কনস্টেবল লিয়াকত ও হারুন আহত হয়। এসময় বিক্ষোভকারীরা একত্রিত হয়ে পুলিশের উপর হামলা চালায়। এতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পথচারিরা চারদিকে ছুটোছুটি করতে থাকে। এসময় বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ৭ জন গুলিবিদ্ধসহ ২০ জন আহত হয়। এদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়। প্রসঙ্গত, কালিহাতী উপজেলা সদরের সাতুটিয়া এলাকার মোজাফফর হোসেনের ছেলে রফিকুল ইসলাম ওরফে রোমার স্ত্রী হোসনে আরার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ঘাটাইল উপজেলার শ্রমজীবী আলামিনের (১৭) প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কয়েক মাস আগে আলামিনের সঙ্গে পালিয়ে যায় হোসনে আরা। পরে তাকে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর গত ১২ সেপ্টেম্বর আবারো আলামিনের সঙ্গে পালিয়ে যায় হোসনে আরা। ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে রোমা ও তার পরিবারের সদস্যরা আলোচনার কথা বলে আলামিন, তার মা ও হোসনে আরাকে রোমাদের বাড়িতে ডেকে আনে। পরে বাড়ির উঠানে আলামিনকে বিবস্ত্র করে রোমা ও তার ভগ্নিপতি হাফিজ। এসময় আলামিনের মাকেও বিবস্ত্র করা হয়। মারধরের পাশাপাশি আলামিনের মাকে ঘরে নিয়ে রোমা ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই ঘটনার বিচারের দাবিতে শুক্রবার স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল বের করে। তারা সড়ক অবরোধ করায় পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে লাঠিপেটা করে, প্রায় ৬০ রাউন্ড গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে। এতে এক নারীসহ ছয় ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়। এছাড়াও প্রায় ৫০ জন আহত হয়। গুলিবিদ্ধ ছয়জনের মধ্যে পরে তিনজন মারা যায়।এমএএস/পিআর
Advertisement