১৯৩০ সাল, নিউ ইয়র্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চলছে ভয়াবহ মন্দাকাল। রাস্তায় রাস্তায় অসংখ্য মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে যাদের কোনো কাজ নেই। আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক ভাবে। সামাজিক অস্থিরতা সর্বত্র দৃশ্যমান। সাদা-কালো দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নিয়েছে। বড় বড় দোকানগুলি ভয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যদি আক্রমণ করা হয় বা লুট হয় সে কারণে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ। যে আমেরিকা মনে করছিলো যে, অর্থনীতিতে তারা সকলকে ছাড়িয়ে বিশ্বকে একক কর্তৃত্বের করতলে নিয়ে আসবে সেই আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র-কাঠামোও হুমকির মুখে। সামাল দেওয়ার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা।
Advertisement
এর বিপরীতে ত্রিশের দশকের জার্মানীতে চলছে এক উৎসবমুখর শিল্পোন্নতি। রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে জীবনোন্নয়ন নিয়ে জার্মানীতে তখন শনৈঃ শনৈঃ অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষ্যমান। সমর-অর্থনীতির ওপর জোর দিয়ে গোটা দেশটাকে পরিণত করা হয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাববার সময় কারো নেই। বরং ইহুদিসহ পৃথিবীর অন্যান্য দুর্বল রাষ্ট্র ও জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিস্তর ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রীয় খরচে। নাৎসিবাদের উত্থান ইউরোপকে চোখ রাঙাতে শুরু করেছে, সামগ্রিকভাবে ইউরোপের অর্থনীতি সে সময় যে খুব একটা ভালো ছিল তা নয়।
আর এই দুই অর্থনৈতিক প্রপঞ্চের মাঝখানে স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলছে আরেক রকম কর্মযজ্ঞ। নিজেদের ভাগ্যতো বটেই বিশ্বভাগ্য বদলানোর স্বপ্নও দেখাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। নিজের দেশের বিরোধীতাকারীদের গুলাগে (সাইবেরিয়ার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) পাঠিয়ে নিশ্চিত হত্যার মুখোমুখি করে স্তালিন বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন, যা বাকি বিশ্বের জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না।
খুব অল্প কথায় এবং কোনো রকম উপাত্ত ছাড়া ত্রিশের দশকে বিশ্ব-পরিস্থিতি আসলে এরকমই ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বোতভাবে তাদের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় রত ছিল, সে জন্য তার প্রয়োজন ছিল একটি যুদ্ধের। জার্মানীতে হিটলার বিশ্ব দখলের জন্য উন্মুখ হয়েই ছিল, ফলে তার কাছে যুদ্ধ ঘোষণা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র, যদিও গোটা ত্রিশের দশক হিটলার যুদ্ধ-প্রস্তুতিই গ্রহণ করেছে কেবল।
Advertisement
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ত্রিশের দশকের মন্দা যে খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারবে না কোনো বড় ধরনের বৈশ্বিক পরিবর্তন (ওয়ার্ল্ড অর্ডার চেঞ্জ) ছাড়া সেটা তখনকার অর্থনীতিবিদ কিংবা গবেষকদের কথা থেকেই স্পষ্ট ছিল। আর এর মাঝে নাক উঁচু ব্রিটেন তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র থেকে বেরুতে চাইছিল, এটা অবশ্য এমনি এমনি নয়, কারণ ভারতসহ বড় বড় কলোনিগুলো ধরে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না।
তাছাড়া সাম্রাজ্যগুলো থেকে যে ঘি-মধু খাওয়ার ছিল তা ততোদিনে খাওয়া হয়ে গেছে, গোটা ব্রিটিশ দ্বীপ সাজানো-গোছানো হয়ে গেছে, উপচে পড়ছে ঐশ্বর্য সর্বত্র অর্থনীতি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ফলে সে সময় ব্রিটিশ অর্থনীতিকে আরো জোরদার করার জন্য একটি বৈশ্বিক যুদ্ধ বিশেষ করে কলোনি-ত্যাগের বাহানা ব্রিটেনের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নকে সকলে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিল বটে কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। বরং হিটলারকে সোভিয়েত-বন্ধু পোল্যান্ড দখলে উস্কে দেওয়া হয়েছিল আর তার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধে জড়ানোর বিকল্প কিছুই ছিল না।
শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। প্রথম মহাযুদ্ধের মতোই এ যুদ্ধ হতে পারতো ব্রিটিশ বনাম জার্মানী’র যুদ্ধ কিন্তু তা না হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জড়ানোর জন্য কৌশলে জাপানকে দিয়ে পল হারবারে বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়ে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধাবস্থায় ফেলে দেওয়া হলো পৃথিবীকে। লক্ষ্য করা যায় যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তে সবচেয়ে লাভবান রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারপর ব্রিটেন এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র জার্মানী হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই যুদ্ধের পর আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে কমিউনিজমও এরপর মাত্র কয়েক দশক বেঁচেছে। তার মানে এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আসলে ক্যাপিটালিজমের একটা কৌশলী চাল ছিল (ছিল কেন বলছি? এখনও আছে) এবং প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ক্যাপিটালিজমের জাতশত্রু কমিউনিজমকে ধ্বংস করে দেওয়ার পথ উন্মুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে শীতল যুদ্ধতো আসলে কমিউনিজমের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা মাত্র।
কিন্তু কথা সেটা নয়, সেই সময়কার বিশ্বের কথা ভাবুন, এতোগুলো বিখ্যাত বিখ্যাত মাথা (যুক্তরাষ্ট্রে রুজভেল্ট, ব্রিটেনে চার্চিল, সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিন, ফ্রান্সে সার্ল দ্য গল) বিশ্বময় থাকার পরও কী করে দু’দু’টি বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটতে পারলো? তার মানে আমরা যতোটা এদেরকে শান্তির দূত কিংবা ওয়ার্ল্ড অর্ডারের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করি না কেন তারা আসলে পৃথিবীকে একাধিক যুদ্ধ উপহার দেওয়া ছাড়া আর কিছু করেননি। কিংবা কেউ কেউ একথাও হয়তো বলবেন যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন আছে এবং তারা সে পথটিই অনুসরণ করেছিলেন। ইদানীং শান্তি ও সংঘাত বিদ্যাপাঠেও একথা জোর দেওয়া হয়ে থাকে যে, শান্তির জন্য প্রথমে যুদ্ধের প্রয়োজন, কারণ তা না হলেতো বোঝার উপায় নেই শান্তি আসলে কী জিনিস।
Advertisement
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে, এই যুদ্ধে যারা একপক্ষ হয়ে কাজ করলো তারাই আবার প্রতিপক্ষ হয়ে শীতল যুদ্ধে জড়ালো পৃথিবী শান্ত হলো না। নব্বইয়ের দশক শেষ হতে না হতেই পৃথিবী পা রাখলো নতুন যুদ্ধমাত্রায়। সন্ত্রাসবাদ নামক এক নতুন যুদ্ধাস্ত্রের আমদানী হলো যা আসলে অন্য যে কোনো যুদ্ধাস্ত্রের তুলনায় ‘লিথল’। পৃথিবীতে গণতন্ত্র নামের এক ‘সোনার পাথরবাটি’র সঙ্গে মানুষের নামে পরিচয় ঘটলেও কাজের ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটলো সম্পূর্ণ বিপরীত। ‘বিগ মানি’র কাছে গণতন্ত্র, মানবতাবাদ নামের যা কিছু ‘ভালো’ তাই-ই উপেক্ষিত হতে শুরু করলো।
নিজেদের গণতন্ত্রের পিতা-মাতা-বড়ভাই দাবি করে দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে কিংবা সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে যে মাত্রায় ‘নাক গলানো’র উদাহরণ তৈরি হলো তাতে কোনো ভাবেই আর ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো তাদের তৈরি ‘গণতান্ত্রিক পথ’ অনুসরণ করতে চাইলো না। বরং সামান্য গণতন্ত্র দিয়ে যদি ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠা করে জনগণের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটানো যায় তাহলে মানুষ যে গণতন্ত্র নিয়ে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করে না সেটা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া পৃথিবীকে বুঝিয়ে দিল। আর এতোবড় চীনতো একথাও বোঝালো যে, প্রতিদিন যদি কয়েকশ করে কোটিপতি হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যায় জনগণকে তাহলে তারা গণতন্ত্র কেন, কিছু নিয়েই ভাবে না, তারা তখন শুধু অর্থের চিন্তা করে।
ত্রিশের দশক থেকে বর্তমানে ফিরি। বিশ্বপরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া যাক। পশ্চিমের অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদ চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। ত্রিশের দশকের মতো অবস্থা না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। গণতন্ত্রের দোহাই পেড়ে ব্রেক্সিট করতে গিয়ে ব্রিটেনের অবস্থা এখন না ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। অর্থনীতি নতুন এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ইউরোপ নিজেদেরকে সকল প্রকার রেষারেষি থেকে সরিয়ে নিয়ে একটি জোট হিসেবে টিকে থাকার জোর চেষ্টা চাালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেখানেও অর্থনৈতিক মন্দা আসি আসি করছে।
অর্থনীতির দন্ডটি পৃথিবীর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হেলে পড়ছে। ত্রিশের দশকের মতো আবারও একটি যুদ্ধ প্রয়োজন কিনা শান্তি ও অর্থনীতি বিনির্মাণে সে প্রশ্ন আবারও উঠছে বিশ্লেষকদের মনে। কারণ আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া এই ভারসাম্য ফেরানো সম্ভব নয় বলে যারা মনে করছেন তারা একথাও বলছেন যে, ত্রিশের দশক আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। চীনারা আর আফিমে বুঁদ হয়ে নেই। ভারতবর্ষ এখন স্বাবলম্বী হওয়ার পথে যদিও বিভেদের রাজনীতি ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে সবার আগে আঘাত হেনেছে, সে গল্প আরেকদিন করা যাবে। ফলে আরেকটি বড় মাপের যুদ্ধ কি পৃথিবীর জন্য অপেক্ষা করছে?
যুদ্ধ-চেষ্টা যে চলছে না তা নয়, মধ্যপ্রাচ্যতো যুদ্ধের জন্য উত্তম কুরুক্ষেত্র। গণতন্ত্রহীনতা আর তেলের-বড়াই এই অঞ্চলটিকে সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেই রেখেছে। ইরানকে কোনঠাসা করে তাকে দিয়েই যুদ্ধ বাঁধানোর যে চেষ্টা পশ্চিম থেকে ক্রমাগত চালানো হচ্ছে তা কতোদিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দু’দু’টি বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে পশ্চিমা পন্ডিতরা উদযাপন করলেও অর্ধ শতাব্দী যেতে না যেতেই আবার যখন অর্থনীতিরই নামে এবং অর্থনীতিরই জন্য একটি যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজমান পৃথিবীতে, তখন গণতন্ত্র নিয়ে মাথাব্যথা খুব মানুষেরই, কেবলমাত্র অ্যাকাডেমিক তত্ত্বেই গণতন্ত্র নিয়ে কচকচানি চলছে, বাস্তবে মানুষ গণতন্ত্র থেকে যোজন দূরে সরে পড়েছে।
যদিও গণতন্ত্র বলতে আদতে ও সত্যিকার অর্থে পৃথিবী কী বোঝে সেটাও স্পষ্ট নয়, কারণ একেক দেশে একেক ‘স্বাধীনতা’কে গণতন্ত্র বলে চালাতে গিয়ে “বৈশ্বিক গণতন্ত্র” (ইউনিভার্সাল ডিমোক্রেসি) বলতে কোনো সুনির্দিষ্ট মানদন্ড দাঁড়িয়েছে কিনা সে প্রশ্নও উঠছে সর্বত্র। প্রশ্ন হলো, এই ডামাডোলে পৃথিবী থেকে কে বিদায় নেবে আগে? গণতন্ত্রের মাতা ‘ক্যাপিটালিজম’ নাকি ক্যাপিটালিজমের সন্তান ‘গণতন্ত্র’? যে কোনো একের মৃত্যু দেখার জন্য খুব বেশিদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয় না।
ঢাকা ১৬ সেপ্টেম্বর, সোমবার ২০১৯লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর