আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২১ আগস্ট স্মরণে ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্রলীগকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যদি ভালো খবরের শিরোনাম হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মা শান্তি পাবে। আমি শুধু তোমাদের আহ্বান করবো ছাত্রলীগকে খারাপ খবরের শিরোনাম করো না।’
Advertisement
কিন্তু আওয়ামী লীগের এই দীর্ঘ শাসনামলে বারবার খারাপ খবরের শিরোনাম হয়ে এসেছে ছাত্রলীগ এবং বারবার এর জন্য বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলকে। যে কারণে এখন হয়তো সময় এসেছে ছাত্রলীগকে কঠোর হাতে সামলানোর। যাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষতো অতিষ্ঠ বটেই বিরক্ত খোদ সরকারপ্রধানও। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এখন আক্ষেপ করে বলেন, দেশে এখন কর্মী নেই, সবাই নেতা। সবাই যেমন আওয়ামী লীগ, তেমনি সবাই নেতা। কারণ স্কুলেও এখন ছাত্রলীগের কমিটি রয়েছে। এরাই এলাকায় দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে।
ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী এতোটাই বিরক্ত যে, মাত্র এক বছর আগে নিজের হাতে করা ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দিতে বলেছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষ নেতার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও তাদের বিরুদ্ধে ওঠা নানান অভিযোগে ক্ষুব্ধ সংগঠনের সাংগঠনিক নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবশেষ ওবায়দুল কাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগের বিষয়টি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী দেখছেন।
২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন ‘ছাত্রলীগ করবে ছাত্ররাই’। ২৭ বছরের ঊর্ধ্বে কেউ ছাত্রলীগ করতে পারবে না। সেই সময় এই বিষয়টা বেশ প্রশংসা পেয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠে যে, সে বছর এপ্রিল মাসে বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে সরে যান। কিন্তু তাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মায়াকান্না কাঁদলেও তাদের যে কিছুই যায় আসে না তা তাদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ হয়।
Advertisement
পরের বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে টেন্ডারবাজি ও অন্য যেকোনো অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। একইসঙ্গে কোনোরকম ছাড় না দিতেও বলা হয় সেই নির্দেশে। ২০১৮ সালের ১২ ও ১৩ মে সম্মেলনে কমিটি করতে পারেনি ছাত্রলীগ। ৩১ জুলাই সম্মেলনের দুই মাস পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম চূড়ান্ত করা হয়। চলতি বছরের ১৩ মে সম্মেলনের এক বছরের মাথায় ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।
প্রথম প্রথম ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সহযোগিতাসহ বেশকিছু কাজে ছাত্রলীগ প্রশংসা কুড়ালেও ধীরে ধীরে তাদের স্বরূপ উন্মোচিত হতে থাকে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। সম্প্রতি কয়েকটি কাজে তাদের বেপরোয়াভাব বিশেষভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের কোনো যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই ‘নব্য ভিআইপি’ হিসেবে পরিচয় পেতে উৎসুক হয়ে উঠেছে এবং সে পরিচয়ের ব্যতয় ঘটলে সম্মানহানির অভিযোগ তুলে ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করছে। বিশেষ করে সিলেটের ঘটনা পুরো জাতি অবাক হয়েছে।
সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ‘ভিআইপি লাউঞ্জে’ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরীর সিলেট থেকে ঢাকায় যাওয়ার সময় ভিড় লেগে যায়। অনেকে চলে যান টার্মাকে। আবার কেউ কেউ বিমানের দরজায় গিয়েও নেতাকে বিদায় জানান। সেলফি তোলেন। অথচ ছাত্রলীগের সভাপতি কোনো জনপ্রতিনিধি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ব্যক্তি (সিআইপি) নন। তাই তিনি ভিআইপি লাউঞ্জের এতো সুবিধা পেতে পারেন না।
এছাড়া শহীদ মিনার বেদিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতার মোটরসাইকেল চালানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে পরীক্ষার সময় নকলে বাধা দেওয়ায় এক শিক্ষককে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মারধর করেছে বলে অভিযোগ উঠে। দুই নেতাকে মারধরের জেরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গোদাগাড়ী বাগানের সব গাছের লিচু প্রকাশ্যে পেড়ে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
Advertisement
সাতক্ষীরার আশাশুনি সরকারি কলেজ অধ্যক্ষের ওপর তিন দফা হামলা ও তার অফিস ভাঙচুর করে ছাত্রলীগ। সন্তানতুল্য এমন ছেলেদের কর্মকাণ্ডে কাঁদেন তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা। কোরবানির ঈদের সময় ছাগল ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। লোড করা পিস্তল নিয়ে ঘোরার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুলিবিদ্ধ হন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ বিষয়ক উপসম্পাদক মেশকাত হোসেন। ছাত্রলীগকে এখনই সামলানো না গেলে হয়তো এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।
এখনই প্রয়োজন তাদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করা। মাঠ পর্যায়ে ছাত্রলীগ নামধারী নেতারা যে কী ধরনের অত্যাচার করছে সেটি প্রশাসনের মাধ্যমেই খোঁজ নিলে জানা যাবে। এতে করে ঐতিহ্যবাহী একটি সংগঠনের কারণে পুরো সরকারের যেমন বদনাম হচ্ছে তেমনি সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ছাত্রলীগের প্রতিও বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। যারা হলে থাকেন তারা সুযোগ সুবিধার জন্য বা নেতাকে ‘তেল দেয়ার’ জন্য হয়তো পিছে পিছে ঘুরছেন কিন্তু প্রয়োজন ফুরোলে এদের কতোটা কাছে পাওয়া যাবে তা সহজে অনুমেয়। ১৯৪৮ সালে যে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অতীত গৌরবের কথা আমরা সবাই জানি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন সংগ্রামে এই সংগঠনটির ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাসই বাঙালির ইতিহাস।’তিনি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ভালোবাসতেন তাদের আদর্শ ও সততার কারণে। সেই কাতারে আমার প্রয়াত অনেক স্বজনও ছিলেন। সেই সুনামকে যে ছাত্রলীগ খারাপ খবরের শিরোনাম করে, অর্জনকে ধূলিসাৎ করতে পিছপা হয় না, শিক্ষাকে বাদ দিয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নিজেকে ভিআইপি হিসেবে দেখার প্রবণতা যে ছাত্রলীগের প্রধান লক্ষ্য হয় তাদের থামানোর এখনই সময়। নইলে আগামীতে হয়তো আওয়ামী লীগকে এর জন্য কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/পিআর