সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে পশ্চিমে ৩০ মিনিট পায়ে হাঁটলেই বেদেপল্লী পোড়াবাড়ি। খানাখন্দে ভরা পল্লীতে যাওয়ার রাস্তাটি কোনো এক সময় পাকা ছিল, তা ইটের সুরকি দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল। অমন রাস্তার উপর ভর করেই রিকশা, অটোরিকশা, ইজি বাইকের যেন ধুম পড়েছে। ঠিকানা বেদেপল্লী পোড়াবাড়ি, অমরপুর ও কাঞ্চনপুর। ইজি বাইকে উঠেই চালক হামিদের সঙ্গে আলাপ হয়। বলছিলেন, ‘এখানে ঈদের মৌসুম একটাই। কোরবানির ঈদ এলেই আয় রোজগার বেশি হয়। গত সপ্তাহ থেকে বেদে-বেদেনীরা পল্লীতে ফিরতে শুরু করেছেন। ঈদের পর আরো দুই সপ্তাহ তারা অবস্থান করবেন। তাই, আমাদেরও বিরতি নেই। দুটি পয়সা ধরার সময় তো এখনই।’আলাপ শেষ হতে না হতেই চালক নামিয়ে দেয় বেদেপল্লীর তিন রাস্তার মোড়ে। ভরদুপুরেই জমে উঠেছে মোড়ের চায়ের দোকানগুলো। দোকানের চেয়ার-বেঞ্চগুলো দখলে নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে বেদে-বেদেনীরা।তবে সেই চিরাচরিত বাচনভঙ্গি আর পোশাকেই মেলে ধরছেন নিজেদের স্বকীয়তা। বেদেদের কেউ কেউ সফেদ লুঙ্গি আর কুর্তা পরে আয়েশি ভঙ্গিতে সিগারেট ফুকাচ্ছেন। কেউ আবার চায়ের কাপে ঠোঁট মেলাচ্ছেন।বেদেনিরাও আড্ডা দিচ্ছেন নিজস্ব ঢংয়েই। সুতি শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে কথার যেন ঝড় তুলেছেন বেদেনীরা। অমন কথায় দুলে দুলে সায় দিচ্ছে মনকাড়া নাকের নথ, কানের দুল, কোমড়ের বিছা আর হাতের বালাগুলোও। খয়ের-জর্দায় পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা বেদেনীরা তুলে ধরছেন পরবাসের আনন্দ আর দুঃখগাথা। বিরতিহীনভাবে কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন, বাকিরা নীরবে শুনছেন। চায়ের দোকানের ওই আড্ডাই বলে দিচ্ছে বেদে সম্প্রদায়ের ঐক্যের কথা। কথা হয়, বেদে সরদার দয়ালের সঙ্গে। প্রায় ১১ মাস পরে বুধবার পল্লীতে ফিরেছেন তিনি। এবারে বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। সর্বশেষ দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জের প্রেমবাজারে ঘাঁটি করেছিল দয়ালের নেতৃত্বে থাকা বেদে-বেদেনীর দল। সেখান থেকেই পুরো দল নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন। জাগো নিউজকে সরদার দয়াল বলেন, ‘বছরের কোনো সময় একত্রিত হওয়া বেদে সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। বিশেষত কোরবানি ঈদকে উপলক্ষ করে আমাদের পূর্বপুরুষেরা নদীর কোনো এক ঘাটে চলে আসত। নদী-নালা না থাকায়, তা আর এখন হয় না। একই কারণে স্থায়ী ঠিকানার জন্য এই পল্লীর পত্তন। শত বছর আগে পল্লীটি গড়ে ওঠার পর থেকেই আমরা (আমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা) কোরবানি ঈদের আগে আগে এখানে চলে আসি।’ তিনি বলেন, ‘ঈদের দুই সপ্তাহ পর আবারো সরদারদের নেতৃত্বে ভাগ হয়ে বিভিন্ন জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ব। বছরের এই সময়টি পল্লীর রং বদলে যায়। অনেক কষ্টে উপার্জিত অর্থ পল্লীতে এসে আমরা দু’হাতে খরচ করি। এই সময়ে কার্পণ্যতার কোনো বালাই নেই। বলতে পারেন, জীবনযাপনের প্রতিযোগিতা।’বেদে সরদার দয়ালের কথায় সায় দেন দোকানি শেরমীও। বলছিলেন, ‘আমরা এই সময়ের জন্য চেয়ে থাকি। গত সপ্তাহ থেকে ব্যবসা জমে উঠেছে। বেদে পরিবারের অনেকেই বছরব্যাপী বাকি খায়। যারা বাইরে থেকে এসেছেন, তাদের অনেকেই বাকি পরিশোধ করে দিচ্ছেন। বেদেপল্লীতে ঈদ আনন্দ একটু আগেই শুরু হয়।’ সাভারের পোড়াবাড়ি, অমরপুর, কাঞ্চনপুর গ্রামে প্রায় ১০ হাজার বেদে সম্প্রদায়ের বসবাস। বছরের অধিকাংশ সময়ই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফেরি করে বেড়ায় বেদে-বেদেনীরা। কোরবানির ঈদকে উপলক্ষ করে পল্লীতে ফিরে আসা এ সম্প্রদায়ের জন্য পুরোনো রীতি। অনেকে আবার পল্লীতে একত্রিত হওয়াকে বাধ্যবাধকতাও মনে করেন। বেদে সরদার তাহের উদ্দিন বলেন, ‘বছরের এই সময় একত্রিত হওয়া আমাদের সমাজের বিশেষ সংস্কৃতি। এই সময়েই বেদে সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের বিয়েসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।’এএসএস/এসএইচএস/এমএস
Advertisement