দেশজুড়ে

কপোতাক্ষের ভাঙন কবলিত স্থানে হচ্ছে গুচ্ছগ্রাম

খুলনার কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের চরে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্প (গুচ্ছগ্রাম)। যেখানে থাকবে মোট ২২০টি পরিবার।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অর্থায়নে ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ ও ৮০টির মত ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে চলমান কাজের মধ্যেই ভেঙে পড়েছে ওই এলাকার কিছু অংশ। গুচ্ছগ্রামের পানি নিষ্কাশনের সময় বালু দিয়ে ভরাট স্থানও ভেঙে নদীতে চলে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে আইলার পর থেকে উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন। এখনও কয়েকশ’ পরিবার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন। তাদের নির্দিষ্ট একটি ঠিকানার জন্য কয়রা সদর ইউনিয়নের গোবরা গ্রামে কপোতাক্ষ নদীর তীরে নির্মাণ হচ্ছে গুচ্ছগ্রাম।

এলাকাবাসীরা জানান, কিছুদিন আগে ওই স্থানের খুব কাছে স্লুইচগেট সংলগ্ন এলাকায় বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা যায় এবং কিছু অংশ ভেঙে বিলীন হয়। তার পর থেকে স্লুইচ গেটটি বন্ধ রয়েছে। সারা বছর এখানে কম-বেশি নদীভাঙন লেগেই থাকে। নির্মাণ কাজ চলাকালীনই নদীতে ভেঙে যায় এই প্রকল্প এলাকার কিছু অংশ। এমন পরিস্থিতে কতদিন এখানে গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা বসবাস করতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

Advertisement

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় ৮০টির ঘরের কাজ প্রায় শেষ। বাকি ঘরগুলো নির্মাণের জন্য কাজ চলছে। পুরো এলাকা কাঁদা-পানিতে সয়লাব। কপোতাক্ষের পাড়ের ভেঙে যাওয়া অংশে শ্রমিকরা মাটি ভরাটের কাজ করছেন, আর তা তদারকি করছেন সদর ইউনিয়নের ৩ নম্বর গোবরা ওয়ার্ডের মেম্বর মো. আব্দুল গফফর ঢালী।

তিনি বলেন, অল্প বৃষ্টিতে তেমন সমস্যা হবে না। যদি একটানা ভারি বৃষ্টি হয়, আর জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের থেকে বৃদ্ধি পায় তবে গুচ্ছ গ্রামে পানি ওঠবে। কাজ চলাকালীন সময় একটি অংশ নদীতে ভেঙে গেছে, সেই স্থান ঠিক করার কাজ চলছে।

স্থানীয়দের মতে নির্মাণ স্থানের ভাঙন ঠেকাতে নদীর পাড়ে ব্লক দিতে হবে। তা না হলে আস্তে আস্তে এলাকাটি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুচ্ছগ্রামে ঘর পাওয়া এক নারী বলেন, আমাদের মতো অসহায়দের সরকার ঘর দিচ্ছে, এতে আমরা খুবই খুশি। সমস্যা হচ্ছে এখানে বালু দিয়ে ভরাট করার পর উপরে কিছু মাটি দিয়েছিল, সেটা তুলে আবার ঘরের মেঝেতে দিয়েছে। ফলে নদীর ঢেউয়ে ও বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে ও ভেঙে যাচ্ছে।

Advertisement

তিনি বলেন, মানুষ যদি ভালোভাবে বসবাস না করতে পারে তাহলে কি সেই ঘর কোনো উপকারে আসবে? ঘর বানিয়ে গৃহহীনদের দেয়ার পর সেখানে বসবাস করা যাচ্ছে কি না তা আর সরকার দেখবে না। এখানে বসবাস করতে হলে ভেঙে যাওয়ার পর আমাদের আবার বার বার মাটি ভরাট করতে হবে। কারণ আমাদেরতো যাওয়ার আর অন্য কোনো জায়গা নেই।

একাধিক বাসিন্দা জানায়, নদীর তীরে ও ভাঙন কবলিত স্থানে এভাবে ঘর নির্মাণ যুক্তি সংগত হয়নি। ভারী বৃষ্টি ও নদীর জোয়ারের পানিতে এই স্থান তলিয়ে যাবে। স্বাভাবিক জোয়ারে কানায় কানায় পানি চলে আসে। সেই সঙ্গে নদী ভাঙতে থাকে। এখানে এসে কপোতাক্ষ একটি বাঁক নিয়েছে। সে কারণে জোয়ারের পানি এই অংশে এসে আছড়ে পড়ে। তাছাড়া এটি কপোতাক্ষের ভরাট হওয়া অংশ। নদী সঠিকভাবে খনন করা হলে এই গুচ্ছগ্রামের বেশ বড় অংশ ভেঙে ফেলতে হবে। তখন কোটি কোটি টাকা পানিতে যাবে।

কয়রা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. জাফর রানা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অর্থায়ানে গুচ্ছগ্রাম-২ প্রকল্পের আওতায় ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯ একর জমিতে ২২০টি বসত ঘর নির্মাণ করা হবে। চলতি বছরের মে মাসে কাজ শুরু হয়েছে, শেষ হবে ডিসেম্বরে। ১২টি আরসিসি পিলারে সঙ্গে টিনের বেড়া ও ছাউনি দিয়ে ২ কক্ষ বিশিষ্ট ঘর করা হবে। আর ৪টি পিলার দিয়ে টিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে করা হবে বাথরুম। এখানে থাকবে খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার ও মসজিদ। পানির প্রয়োজন মিটানোর জন্য ১০টি নলকূপ বসানো হবে। এখানে যারা ঘর পাবেন তাদের ঘরের দলিল দেয়া হবে, নিজস্ব বিদ্যুতের মিটার, উন্নত চুলা দেয়া হবে। তাছাড়া কিছু চাষের জমিও দেয়া হবে। ২২০টি ঘরে বিপরীতে ৭০০ জনের আবেদন জমা পড়েছে।

তিনি বলেন, নদীর পাড়েই গুচ্ছ গ্রাম হয়। কারণ খাস জমি নদীর পাশেই পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে ডিসি ও ইউএনও সাহেবের সমন্বয়ে এই জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নদীভাঙনের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পটি নদী থেকে বেশ দূরে রয়েছে। তাছাড়া ভাঙন রোধে আমরা কাজ করছি। পরে আরও কাজ করা হবে। নদী কখনও পাশে খনন করা হয় না শুধু মধ্যে একটু খনন করা হয়। তাছাড়া নদীতো দিনদিন মরে যাচ্ছে। সবাই তো আর ঘর পাবে না। কিছু লোক যারা ঘর পাওয়ার উপযুক্ত নয় তারাই দেশ ও জনতার উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন কথা রটিয়ে জনসাধারণের মনে ভয় ধরাচ্ছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ মো. আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তারা যাতে বসবাস করতে পারে, এমন করণীয় সবই সেখানে করা হবে। এজন্য তিনি অচিরেই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানপূর্বক নিজে তদারকিও করবেন বলে জানান।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, কয়রার গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প এলাকা বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। প্রকল্পের কাজ তদারকির জন্য ইতোপূর্বে ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই কাজে কোনো রকম গাফলতি গ্রহণযোগ্য হবে না- এমন নির্দেশনা দেয়া আছে। তারপরও নিজে প্রকল্পটি সার্বক্ষণিক তদারকির কথা জানান তিনি।

ইউএনও শিমুল কুমার সাহা বলেন, গুচ্ছগ্রাম যাতে ভাঙনের কবলে না পড়ে আর পানিতে তলিয়ে না যায় সে বিষয়ে আমাদের লক্ষ্য আছে। এখানে আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে। পর্যায়ক্রমে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আলমগীর হান্নান/এমএমজেড/এমকেএইচ