>> লাইফ ফান্ডের ৩০% সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক>> বছরের পর বছর ধরে এ নিয়ম লঙ্ঘন করে আসছে কোম্পানিটি>> ৯৬৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকার স্থলে বিনিয়োগ ৩৭১ কোটি ৪৫ লাখ
Advertisement
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম করছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। বিনিয়োগে অনিয়মের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিলেও তা আমলে নিচ্ছেন কোম্পানিটি। গত কয়েক বছরের মতো চলতি বছরেও জীবন বীমা কোম্পানিটি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একটি জীবন বীমা কোম্পানিকে তাদের পলিসিহোল্ডারদের দায় বা লাইফ ফান্ডের ৩০ শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বাধ্যতামূলক বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু বছরের পর বছর তা লঙ্ঘন করে আসছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইডিআরএ থেকে কোম্পানিটি-কে আইন মানতে দফায় দফায় সময় বেঁধে দেয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না।
চলতি বছরের জুন শেষে ফারইস্ট লাইফের সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ রয়েছে ৩৭১ কোটি ৪৫ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৪ টাকা। অথচ আইন অনুযায়ী, এ খাতে কোম্পানিটির সর্বনিম্ন বিনিয়োগ থাকার কথা ৯৬৫ কোটি ৫৭ লাখ ৩৯ হাজার ৬৫৭ টাকা। অর্থাৎ সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ কম রয়েছে ৫৯৪ কোটি ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৩ টাকা।
Advertisement
বিনিয়োগের এ অনিয়মের কারণে গত ২০ আগস্ট আইডিআরএ থেকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ-কে একটি চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, বীমা আইন ১৯৩৮ এর ২৭ ধারা এবং বীমা বিধিমালা ১৯৫৯ এর বিধি ১০-ক বিধান অনুযায়ী, লাইফ ফান্ডের ৩০ শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজ খাতে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু আপনার কোম্পানি কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে এ বিধি লঙ্ঘন করে আসছে।’
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)-কে লেখা ওই চিঠিতে অনিয়মের লিখিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের হালনাগাদ কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে আইডিআরএ’র কার্যালয়ে শুনানিতে ডাকা হয়েছে।
এ বিষয়ে আইডিআরএ সদস্য ড. এম মোশারফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ যে আচরণ করছে তাতে স্পষ্ট যে, কোম্পানিটিতে সুশাসনের অভাব আছে। আমরা বিনিয়োগে অনিয়মের কারণে কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়েছি এবং তাদের শুনানিতে ডেকেছি। এখন তারা কী ব্যাখ্যা দেয় আমরা দেখব।’
বীমা সংশ্লিষ্টদের মতে, জীবন বীমা কোম্পানির গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকলে গ্রাহকের টাকা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। কোনো কোম্পানি এ নির্দেশনা না মানলে বীমা আইন- ২০১০ এর ‘ঘ’ ও ‘ছ’ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে আইডিআরএ।
Advertisement
শুধু চলতি বছর নয়, বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বিনিয়োগে অনিয়মের তথ্য পেয়েছে আইডিআরএ। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটি-কে কয়েক দফা চিঠিও দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ‘বাধ্যতামূলক সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ না করে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স’- চিঠিতে এমন মন্তব্যও করেছে আইডিআরএ। এমনকি একাধিকবার কোম্পানিটির লাইসেন্স বাতিলের হুমকিও দেয়া হয়েছে।
তবে এ হুমকির কোনো তোয়াক্কাই করেনি বেসরকারি এ জীবন বীমা কোম্পানিটি। সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের এ বাধ্যবাধকতা বছরের পর বছর লঙ্ঘন করছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে লাইসেন্স বাতিলের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ হুমকি থেকে গেছে কাগজে-কলমেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের জন্য আইডিআরএ থেকে ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর ফারইস্ট ইসলামী লাইফকে একটি চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠিতেও বিনিয়োগের জন্য সাতদিন সময় বেঁধে দেয়া হয়। অন্যথায় বীমা আইনের বিভিন্ন ধারায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয়। একই সঙ্গে কোম্পানিটি আইডিআরএ’র নির্দেশ অমান্য করে কর্তৃপক্ষের প্রতি অত্যন্ত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন ও আইডিআরএ’র কাছে দাখিল করা তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২৬১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৯৭ হাজার ১৯৯ টাকা। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ২৯৮ কোটি ২২ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ টাকা। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ছিল ১১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২৫১৪ কোটি ৯১ লাখ ৩৩ হাজার ৮১৬ টাকা। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ১৭৭ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ২৯২ টাকা বা ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।
২০১৬ সালে কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২৬২৩ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ছিল ৫৪ কোটি ৭০ লাখ ২৬ হাজার ৪৯৬ টাকা বা ২ দশমিক ৯ শতাংশ।
২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২৬৯৩ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ছিল এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ দশমিক শূন্য ৫৭ শতাংশ।
২০১৪ সালে কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২৫৯১ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ছিল এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ দশমিক শূন্য ৫৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পলিসি হোল্ডারস লায়াবিলিটি বা জীবন বীমা তহবিলের ৩০ শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফকে বছরের পর বছর ধরে চিঠি দিয়ে আসছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। বিনিয়োগের আইন মানতে ২০১৬ সালেই কোম্পানিটিকে ৬ দফা নির্দেশ দেয়া হয়।
এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর ফারইস্ট ইসলামী লাইফকে পাঠানো চিঠিতে বিনিয়োগ নীতিমালা পরিপালনের বিষয়ে পাঁচটি নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে এসব নির্দেশ পরিপালন করা না হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এরপর ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল সাতদিনের সময় দিয়ে চূড়ান্তভাবে আরেকটি চিঠি দেয় আইডিআরএ। চিঠিতে নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
এসব চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর এক চিঠিতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্দেশনা অনুসারে সিকিউরিটিজ বন্ডে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করা হবে।
আরেকটি চিঠিতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ আইডিআরএ-কে জানায়, আমরা এরই মধ্যে ১০১ কোটি ৫৬ লাখ ২৩ হাজার ৫৬৩ টাকা বিনিয়োগ করেছি এবং এই ধারা অব্যাহত রেখেছি। একই সঙ্গে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগযোগ্য ফান্ড বিনিয়োগের জন্য ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
তবে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পার হয়ে আরও দেড় বছর চলে গেলেও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ বিনিয়োগে অনিয়ম থেকে সরে আসেনি। দফায় দাফায় হুমকি দিয়ে চিঠি দিলেও বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা অদৃশ্য কারণে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন ভূমিকার বিষয়ে আইডিআরএ সদস্য ড. এম মোশারফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, এবার আর ফারইস্ট ইসলামী লাইফ-কে ছাড় দেয়া হবে না। বিনিয়োগে অনিয়মের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত ব্যাখা দিতে না পারলে অবশ্যই এবার কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। আমরা অনেক সময় দিয়েছি। আর সময় দেয়া সম্ভব নয়।
বিনিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্যাহর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম