দেবর জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান মেনে নিয়েছেন এরশাদপত্নী রওশন। বিনিময়ে তিনি হলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। সেইসঙ্গে পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান। আর রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হলো এরশাদ-রওশনপুত্র সাদ এরশাদকে। সংসদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ বিরোধীদলীয় উপনেতাও জিএম কাদের। এসবের মধ্য দিয়ে দল এবং সংসদের মূল পদগুলো থাকলো এরশাদ পরিবারেই। রংপুরে এরশাদের শূন্য আসনসহ কিছু পদ-পদবীর জন্য যারা গত ক’দিন দু-তিন দিকে দৌড়-ঝাঁপ করেছিলেন আপাতত চুপসে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই তাদের।
Advertisement
জাতীয় পার্টির ইনার রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনরা গত ক’দিন থেকেই বলে আসছিলেন রওশন-কাদের নাটকীয় সমঝোতার মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিতে গণতন্ত্র-পরিবারতন্ত্র কায়েম হবে। এর বিপরীতে কিছু মিডিয়াসহ মহল বিশেষ শঙ্কা করছিল দেবর-ভাবীর বিরোধে আবার ভেঙে যেতে পারে দলটি। তাদের ধারণা মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। এর মাঝেই আড়াল থেকে এসে নীরবতা ভেঙে এসব সমঝোতার জানান দিলেন এরশাদের ভাগ্নে হিসেবে প্রচারিত জাপার মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। দলের সব ঝামেলা মিটমাটের মিডিয়েটর হিসেবে নিজেকে সফল মহাসচিবও দাবি করেছেন তিনি।
মামী রওশন ও মামা কাদেরের বিরোধের সময় গা ঢাকা থাকার একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন রাঙ্গা। তার মতে, রাজনীতিতে কখনো কখনো ডুব দিয়ে থাকতে হয়। এদিকে, এরশাদ পরিবারের আরেক সদস্য ভাগ্নে জামাই প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলুও উৎফুল্ল। তার মতে, জাতীয় পার্টিই দেশের সব’চে জনপ্রিয় দল। এর প্রমাণ গত ক’দিন পত্রিকায় জাপার যতো শিরোনাম হয়েছে অন্য কোনো দল নিয়ে ততো হয়নি।
অন্যদের কাছে শুনতে হাস্যকর লাগলেও এ ধরনের মানসিকতা, ব্যাখ্যা, যুক্তির বেশ কদর জাতীয় পার্টিতে। জীবদ্দশায় এরশাদ তার গোটা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনে এমনটিই করেছেন। সকাল-সন্ধ্যা, মাঝে দুপুরে আরেক কথা ও সিদ্ধান্তে তিনি সবাইকে জমিয়েও রেখেছিলেন। স্ত্রী রওশন, ভাই কাদেরকেও দল থেকে বহিষ্কার করেছেন। আবার দলে নিয়েছেন, পদ-পদবী উন্নীতও করেছেন। রাঙ্গা, বাবলু, রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদরাও এতে অভ্যস্ত। গুণ-বৈশিষ্ট্যে তারাও মানসিকভাবে একেকজন এরশাদ।
Advertisement
কারো কারো মতে, নিজ দলে এরশাদের যতো ফলোয়ার্স রয়েছেন অন্য দলে এ পরিমাণ নেই। আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু- শেখ হাসিনা, বিএনপিতে জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়ার এতো অনুসারি নেই যা আছে জাপায় এরশাদের। তারা ব্যক্তিজীবনেও চর্চা করেন এরশাদকে। যার আরেকদফা আনুষ্ঠানিক শো-ডাউন হয়ে গেল রওশন-কাদের ইস্যুতে। একেক সময় একেক কথা, একেক পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ায় তারা কেউ কারো চেয়ে কম নন। কাজের মাধ্যমে এরশাদের প্রতিচ্ছবি কম-বেশি তাদের সবারই।
দেবর-ভাবীতে ছিল এরশাদের সৌন্দর্যেরই ছায়া। এবার অল্প সময়ে রাজনৈতিক ব্যাপক বিনোদন দিয়েছেন এরশাদ অনুসারীরা। নিজেদের টম অ্যান্ড জেরি বা সার্কাস ধরনের গোলমালের শো-ডাউন স্থগিত রেখে রবিবার বিকালে শুরু হওয়া কার্যোপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে যোগ দিয়েছেন রওশন এরশাদ। পরে যান সংসদ অধিবেশনে। রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা করার প্রস্তাব স্পিকারের কাছে পাঠাতে দেরি হয়নি। জিএম কাদের স্বাক্ষরিত চিঠিতে পার্টির ২৫ জন এমপি স্বাক্ষর নিতেও সমস্যা হয়নি।
এরশাদের মৃত্যুতে দলে বা রাজনীতিতে আদর্শিক শূন্যতা তৈরি হয়নি। দলের বাইরেও এরশাদের আদর্শ রাজনৈতিক কৌশল বা স্মার্টনেস হিসেবে আলোচিত। কারো কারো কাছে সমাদৃতও। এরপরও তার মৃত্যুতে সাময়িক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল মোটা দাগে তিনটি বিষয়ে। পার্টির চেয়ারম্যান পদ, পার্লামেন্টারি নেতা এবং রংপুর-৩ আসনটি ফাঁকা হওয়া। দেবর-ভাবীর পারিবারিক মিলমিশে এই ৩ শূন্যতাও পূরণ হলো। এর বাইরে সাফল্য হিসেবে যোগ হয়েছে জাতীয় পার্টি তার এই সার্কাসে সরকারকেও একাত্ম করে নিতে পেরেছে। অথবা সরকার জাতীয় পার্টির ড্রামাকে জমিয়ে রাখতে অবদান রাখছে।
সংসদে এরশাদের ব্যাপক প্রশংসা হয়েছে তার ওপর আনা শোক প্রস্তাবের আলোচনায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ থেকে শুরু করে সরকারি দলের অন্য নেতারাও এরশাদের প্রশংসা করেন। এরশাদ বড় ভালো লোক ছিলেন পর্যন্তই থামেননি তারা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির দুয়েকজন সদস্য এই এরশাদ বন্দনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে শিকার হয়েছেন তুলাধুনার। গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুতির প্রায় ৩০ বছর পর কবরবাসী এরশাদের আত্মার জন্য এটি অবশ্যই শান্তিদায়ক। গৌরবের। আর জাতীয় পার্টির জন্য স্বস্তি ও প্রণোদনার। সেইসঙ্গে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতির জন্য আশা জাগানিয়া।
Advertisement
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম