মতামত

আমার ভাই, আব্দুন নূর তুষার

লিখতে বসে প্রায়ই অসহায় বোধ করি আমি। কখনও ভালো বাংলা শব্দ হাতড়াই, কখনও কোনও ইংরেজি শব্দের অর্থ জানা নেই। আমার লেখক জীবনের খুব প্রাত্যহিক ঘটনা এটি। ডিকশনারি খুঁজব, গুগল করব অত ধৈর্য্য নেই আমার। তার চেয়ে অনেক সহজ, একটা ফোন করে ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে নেওয়া।ভাইয়াকে ফোন করার অবশ্য আরও অনেক সুবিধে আছে। শব্দ কিংবা অর্থ জানতে গিয়ে কখনও কখনও বিষয়টি সম্পর্কেও আরও বেশি জানা হয়ে যায়। লাভটা এখানেই! জানা নেই, এমন কোনও বিষয় বোধহয় তার জানা নেই। একজন মানুষ কি করে একই সঙ্গে ডিকশনারি ও এনসাইক্লোপিডিয়া হতে পারে, সেটি তাকে না দেখলে উপায় নেই বোঝার। আর হবেই না বা কেন, যে মানুষটিকে আমি প্রায় কুঁড়ি বছর ধরে বিচিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করতে দেখছি, তার তো তা বরং না হবার কথাও নয়। একই সঙ্গে একজন মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, শিল্পকলা, ভাষাতত্ত¡, চিকিৎসা, তথ্যপ্রযুক্তি, স্থাপত্য, ইতিহাস, ভ‚গোল, আইন প্রায় সকল বিষয়ে জানবেন এমন মানুষ, এ সমাজে বিরল।কখনও কখনও ভাইয়ার সঙ্গে মতের অমিল হয়, হয় তুমুল তর্ক। আমার মতো যুক্তি দিই, সে তার মতো। যুক্তিতে তার সঙ্গে যদিও পেরে উঠা প্রায় দুঃসাধ্য, তবু আমি বরাবরই আমার মতো। অন্যের যুক্তিকে, অন্যের প্রতি সম্মান রেখেই যে খণ্ডন করা যায়, এটি তার কাছ থেকেই শেখা। মতান্তর হলেও মনান্তর হয়নি কখনও। কি করে বিতর্ক করতে হয়, সুস্থ বিতর্ক চর্চা, এ শুধু আমি নই, আমার মতো অসংখ্য তরুণেরা তার কাছ থেকেই শিখেছে। প্রায় ২৫ বছর ধরে এদেশে তার হাত ধরেই প্রাতিষ্ঠানিক বিতর্কের চর্চা।আমার বই পড়ায় তার একটি বড় ভ‚মিকা রয়েছে। যেদিন যখনই তার সঙ্গে দেখা, হাতে কোনও না কোনও একটি বই থাকবেই। বেশির ভাগ সময়ই নিজের পড়া হলে, সে বই সে আমাকে পড়াবেই। এখনও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের হয়ে তরুণদের বই পড়ায় উৎসাহিত করতে বলা যায়, পুরো বাংলাদেশই ঘুরছে। তার পড়ার ক্ষেত্রে, লেখাপড়ার ক্ষেত্রে, তার কাছাকাছি যাওয়া সত্যিই দুষ্কর। একরাতে ঢাউস ঢাউস সব বই পড়ে শেষ করতে দেখেছি প্রায়ই। শুধু বই পড়া কেন, একরাতে কোনও একটি ঢাউস বইয়ের পান্ডুলিপি সম্পাদনা কিংবা পুরো বইটি জুড়ে কী কী ভুল রয়েছে তা সনাক্ত ও সংশোধন তার কাছে নিন্তাতই মামুলি ব্যাপার। ‘টেলিভিশন জীবনের সঙ্গী’ ফরিদুর রেজা সাগরের লেখা বই। সে বইটিতে বানান ও তথ্যগত কী কী ভুল রয়েছে তা সংশোধন করে সকালে ফরিদুর রেজা সাগরের হাতে দিয়ে আসতে দেখে, আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। আমার নিজের লেখা বই ‘একজন আদর্শ মানুষ মুহম্মদ জাফর ইকবাল’ সে বইটিরও সংশোধন করে দিয়েছিল গভীর স্নেহে, একরাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টয়!আমি তত ভালো নই, ভাইয়া যত ভালো লেখাপড়ায়। আমি তার কাছে এখনও বকা খাই। কী লাভ হলো তোর ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে, দেশে বিদেশে পড়ে। এখনও  একপাতায়  পাঁচটা ভুল! চুপ করে থাকি আমি বকা খেয়ে। এমন নির্ভুল বাংলা ও ইংরেজি, বলা ও লেখা, কম দেখেছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সেরা ছাত্রদের একজন। গোল্ড মেডেলিস্ট। ‘গ্রেইস এনাটমি’ বইটার যেখান থেকেই জানতে চাইত শিক্ষকেরা, সে উত্তর দিত।যখন যে কাজটিই করত, করেছে, শতভাগ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, সততা নিয়ে। সে কারণেই হয়তো টেলিভিশনে ‘শুভেচ্ছা’ এত জনপ্রিয় হয়েছিল। শুধু ‘শুভেচ্ছা’ কেন,  ‘বাউবি বারো’, ‘ক্রিকেট ক্রিকেট’, ‘হরলিক্স জিনিয়াস বাংলাদেশ’, ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’, ‘জয়তু’, কোনটি অজনপ্রিয়? ছন্দমিলিয়ে, ছড়া কেটে কেটে কথা বলার সস্তা রুচির বিপরীতে নান্দনিক, নাগরিক বাচনভঙ্গি আলাদা করেছে ভাইয়াকে। যুক্তিপ্রবণ মানুষের কথা শুনতেও লোকে ভালোবাসে। রেডিওতে ‘সঙ আলাপ’, ‘খোলামন’, ‘তুষারপাত’ সে কারণেই  শ্রোতারা শুনেছে মনোযোগ দিয়ে।একটা কথা আমাকে প্রায়ই বলে আমার ভাই, জগতে কোনো কিছুই চূড়ান্ত অর্থে অপরিহার্য নয়। যেকোনো মূল্যে কোনও কিছু পেতেই হবে অমন নয়। জীবনের আনন্দটাই সবচেয়ে বড়, জীবনে। টাকার জন্য, ক্ষমতার জন্য যেন না ছুটি, মরিয়া না হই। সে আমি হইনি, সেও নয়। সে কারণেই হয়তো বিসিএস দেওয়া সরকারি চাকরিটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ছাড়তে পেরেছিল অমন অবলীলায়। অথচ তখন সে খুব সাধারণ একজন চিকিৎসক মাত্র, হাতে কোনও প্রকার জমানো টাকাপয়সাও নেই। আছে নিজের মেধা, যোগ্যতা, পরিশ্রম করার দুর্নিবার মানসিকতা শুধু। এই মানসিকতাই  তাকে খাদের কিনার থেকে, জীবন জুয়ার নিশ্চিত হেরে যাওয়া থেকে চ‚ড়ান্ত জিতিয়ে দিয়েছে জীবনে। ভাই বলে নয়, প্রত্যাখানের এমন শক্তি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি, এক জীবনে। সবাই যখন পাবার, নেবার, রীতিমতো কেড়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায়, সে তখন চরম প্রতিযোগিতাহীন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একা। আসলেই একা। এমন মানুষেরা একাই হয়। খুব মাখামাখি ধরনের বন্ধুত্ব তার কারও সঙ্গে দেখিনি কখনোই। এমন স্পষ্টবাদী, সত্যভাষী, যুক্তিপ্রবণ, নির্মোহ, অনিরপেক্ষ মানুষ এ সমাজে যে কারও জন্যই বিপজ্জনক রীতিমতো।আজকাল তার ফেসবুক পোস্ট, স্ট্যাটাস নিয়েও তুমুল তোলপাড় হয়। চিরকালই সে নিজস্ব চিন্তা ও যুক্তিআশ্রয়ী। বেশির ভাগ লোকই নিজের মতো করে চিন্তা করে না, অন্যের চিন্তাকে অনুসরন করে, প্রভাবিত হয়। ফলে তার নিজস্ব চিন্তা, নতুন চিন্তা, তরঙ্গহীন জলে তোলপাড়। সেদিন দেখলাম, প্রায় দেড় লাখ মানুষ তার ফেসবুক ফলোয়ার। বেশির ভাগ মানুষই খুব সাধারণ মানুষ। যারা তার পোস্ট পছন্দ করে, লেখা পড়ে, উপস্থাপনা ভালোবাসে, তার বক্তৃতা শোনে। এই মানুষদের কারণেই আমার ভাই তুষার, আজ আব্দুন নূর তুষার। মানুষের ভালোবাসার তুষার।১৯ সেপ্টেম্বর আমার ভাইয়ের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, ভাইয়া। ভাইয়া আমার প্রিয় বন্ধুও, যার প্রতি আমার ভালোবাসা আছে, শ্রদ্ধা আছে, আছে প্রবল স্নেহও। আমার ভাই নয় শুধু, আমাদের ভাই। এদেশের অসংখ্য তরুণ যারা মেধা, মননে, সৃজনশীলতায়, বিজ্ঞান চর্চায়, মুক্তচিন্তায়, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে আগামীর তাদের বাতিঘর।ভাইয়ার কাছে চাওয়ার চেয়ে আমার পাওয়া বেশি। কে আছে ভাইয়ার মতো,  অমন ভালোবাসবে আমাকে! স্নেহ, শাসন, ভালোবাসা? ভাইয়াকে আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে, এই ভাই জানিস তুই, কত ভালোবাসি তোকে!লেখক: সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্রডিরেক্টর, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশনসম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচপিআর

Advertisement