যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যটি ঋতু বৈচিত্র আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এখানে আছে পাঁচটি বিশাল আকৃতির লেক যা সারা বছর সুপেয় পানির যোগান দেয়। লেকগুলো এতই বড় যে দেখলে মনে হবে একেকটি সমুদ্র। আছে খুব সুন্দর বিচ, চাঁদের আলোয় বালু কণিকা মক্তার মতো ঝলমল করে।
Advertisement
প্রকৃতির এই সুধা পান কিন্তু ক্ষণকালের জন্য, বছরের দীর্ঘ সময় থাকে কনকনে ঠাণ্ডা। হেমন্তের শেষ দিকটায় তাই সবার মন খারাপ হয়ে যায়, এখানে হেমন্ত এক কদম পেছালে শীত যেন দু’কদম সামনে এগোয়। হেমন্তের বিদায় লগ্নে যখন প্রকৃতি শীতের আগমনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, মিশিগান অঙ্গরাজ্যের নোভাই এবং নর্থভিলের বাঙালিরাও কিন্তু ভুলে নাই শেষবারের মতো হেমন্তের মায়াভরা প্রকৃতির মাঝে একটি দিনের জন্য হারিয়ে যেতে।
নোভাই মিডল স্কুলের পাশে ওয়াইল্ড লাইফ পার্কের সবুজ চত্বরটি যেন আরও বেশি সবুজ হয়ে গিয়েছিল সবুজ বাংলাদেশের মানুষদের আনাগোনায়। জি হ্যাঁ, এই পার্কেই বরাবরের মতো আয়োজন করা হলো বাঙালি বাৎসরিক পিকনিকের। পয়ত্রিশটি পরিবারের পায় একশ জনেরও বেশি মানুষ পুরো দিনটিই কাটিয়ে দিল এক সাথে।
বিদেশ বিভূঁইয়ের অনেক দুঃখ কষ্ট ভুলে হাসি মুখে সবাই উপভোগ করল যতসব আয়োজন। ৭ সেপ্টেম্বর, পিকনিক আয়োজক কমিটির সদস্যদের জন্য সকালের সূর্যটি যেন একটু আগেভাগেই উদয় হয়েছে। সকাল হতেই আয়োজক কমিটির সদস্যরা ছোটাছুটি শুরু করে দিল বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে পিকনিকের স্পটে যেতে।
Advertisement
এক সাথে অনেক মানুষের আয়োজন চাট্টিখানি কথা না। প্রধান আয়োজক ফোর্ড মটরসে কর্মরত শরীফ হাসান গত কয়েক দিন যাবৎ দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছে কীভাবে এই আয়োজনকে সামগ্রিকভাবে সফল করা যায়। পিকনিকের চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে, পিকনিক স্পট রিজার্ভ করা, পিকনিকের জন্য জিনিস পত্র কেনাসহ অনেক কিছু।
আজ সে হাজির হলো পিকনিক স্পটে সবার আগে গাড়ি ভর্তি করে অনেক জিনিস পত্র নিয়ে। আমি আর শরীফ দু’জনে মিলে সেগুলো আস্তে আস্তে নামিয়ে রাখলাম। তারপর জেনারেল মটরসে কর্মরত সৈয়দ ফয়সাল ভাইয়ের ট্রাকটি অনেক ভারি মাংস পোড়ানোর মেশিনগুলো নিয়ে হাজির হলে আমরা সবাই একসাথে ওগুলো নামিয়ে আগুন জ্বালানো শুরু করে দিলাম।
এরই এক ফাঁকে ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী ভাইয়ের হাতে মাখানো মুড়ি খেয়ে নিলাম সবাই। মুড়ি মাখানো এতই মজা ছিল যে মনে হয়েছিল উনি কোন এক কালে ঝাল মুড়ি বানিয়ে বিক্রি করতেন! দুপুর বারোটার পর আস্তে আস্তে সবাই আসতে শুরু করল। বারবিকিউ এর দায়িত্ব ছিল মাঞ্জুরুল হাসান টিটু ভাই, মিন্টু ভাই, আরীফ ভাই এর উপর।
আমরা সবাই বারবিকিউয়ের চারপাশে অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন মাংস পোড়া শেষ হবে, বাচ্চাদের উৎসাহ ছিল চোখে দেখার মতো। মাংস পোড়া শেষ হতেই সবাই খুব পেটভরে রুটি মাংস খেয়ে নিল। খাবার দাবার ছাড়াও ছিল অনেক খেলাধুলার আয়োজন। খাওয়া দাওয়া শেষ করেই আমরা খেলাধুলায় মেতে উঠলাম।
Advertisement
বড়দের জন্য ছিল ভলিবল, মহিলাদের জন্য ছিল বাংলার মেয়েদের প্রিয় লুডু টুর্নামেন্ট। আর বাচ্চাদের জন্য ছিল বিভিন্ন রকম খেলনা। মানুষ যখন দেশের বাইরে থাকে, দেশকে খুব মিস করে। তাই প্রতিনিয়ত দেশের চিন্তায় মশগুল। পিকনিকের আড্ডার মাঝেও ছিল দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা।
এবার পিকনিকে বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে আসা নাজমুল হাসান ভাইয়ের বড়ভাইও যোগদান করেছিলেন। ওনি পেশায় ডাক্তার হলেও একসময় রাজনীতি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধও করেছেন। স্বাভাবিক নিয়মেই তিনি ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। এছাড়াও হিতাচি কর্পোরেশনে কর্মরত তরুণ গবেষক চন্দ্রনাথের এক আত্মীয়ের উপস্থিতি এই পিকনিককে করেছে অনেক প্রাণবন্ত।
শেষবেলার দিকে খাবারের মাঝে ছিল খাসির বিরিয়ানি। সবশেষে বাঙ্গালীর প্রিয় চা। খাওয়া-দাওয়া আর গল্পের মাঝে সারাটা দিন যেন কখন চলে গেল টেরই পাইনি, মনে হচ্ছিল আর একটু সময় যদি থাকা যেত। কিন্তু হায়, চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছিল তাই বাধ্য হয়েই আমাদের সমাপ্তির দিকে যেতে হলো। তাই আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তির পূর্বে বিভিন্ন খেলায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
এই পিকনিকের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের মাঝে বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় করার পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মকে দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করে দেয়ার সুযোগ পাই। আমরা সবাই আশা করি প্রতি বছর এই পিকনিকের আয়োজন করতে পারব আর দুঃখ কষ্টে সবাই মিলেমিশে থাকব।
নূরুল আনোয়ার মামুনসিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার (সেমি-অটোনোমাস ভেহিকেল সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট)রবার্ট বোস এল এল সি, যুক্তরাষ্ট্র
এমআরএম