সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পরদিন ১৫ জুলাই এই কলামে আমি লিখেছিলাম ‘জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অন্ধকার!’ সেই কলামের শেষটা দিয়ে আজকের লেখা শুরু করছি, ‘বাংলাদেশে মূল দলগুলো ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক। জাতীয় পার্টি তার ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং সবচেয়ে বড় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তাই এরশাদের মৃত্যুর পর তার পরিবার থেকেই কেউ না কেউ দলের হাল ধরবে, এটাই স্বাভাবিক।
Advertisement
এরশাদ তার ছোট ভাই জি এম কাদেরকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে গেছেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে পার্টির নেতারা কতদিন জি এম কাদেরকে মানবেন, সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জি এম কাদের একদমই তার ভাইয়ের মত নন। তিনি সৎ, শিক্ষিত, ভদ্রলোক, নরম সরম মানুষ। জাতীয় পার্টিতে যে ধরনের মানুষের সমারোহ, তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মত যথেষ্ট নিম্নরুচির তিনি নন। জি এম কাদের যদি এই টাউটদের বাদ দিয়ে দলকে নতুন করে ঢেলে সাজান, তাহলেই কিছু সম্ভাবনা আছে।
জি এম কাদের না পারলে রওশন এরশাদকে দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু জাতীয় পার্টির মত একটি দলকে এগিয়ে নেয়ার মত ক্যারিশমা তার নেই। এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদ নিতান্তই একজন সাধাসিধা নারী। তারচেয়ে বড় কথা হলো এরশাদ বেঁচে থাকতে পার্টিতে তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলেন রওশন। আর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দেবেন রওশন, দলে এরশাদপন্থিরা এটা মানতে চাইবেন না। তাই জাতীয় পার্টি সামনে প্রথম ঝামেলা হবে নেতৃত্ব নিয়ে।
জাতীয় পার্টি যদি সরকারের লেজুড় ছেড়ে সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, জি এম কাদের যদি বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে পার্টিকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে সামনে এগুতে চান; তাহলে জাতীয় পার্টির সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত। আর যদি নেতৃত্ব নিয়ে নেতারা কামড়াকামড়িতে জড়িয়ে পড়েন তাহলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।’
Advertisement
আমার সে আশঙ্কা সত্যি হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এরশাদের মৃত্যুর চারদিনের মাথায় মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙা জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এরশাদ বেঁচে থাকতেই তার ছোট ভাই জি এম কাদেরকে তার উত্তরসূরি মনোনীত করে যান। তাই এরশাদের অনুপস্থিতিতে জি এম কাদেরই পার্টির চেয়ারম্যান হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে এরশাদের মৃত্যুর চারদিনের মধ্যেই সেটার ঘোষণা দলে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। তবে সেই ক্ষোভ, অসন্তোষ অনেকটা চাপাই ছিল।
ছাই ভেদ করে একদিন আগুনটা বাইরে আসেনি। তবে আগুনটা তো ছিলই। তাই এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনে মনোনয়ন প্রশ্নে আগুন কিছুটা ছাই ভেদ করে সামনে আসে, ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে। সেটা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে গত সপ্তাহে জি এম কাদের তাকে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ঘোষণা করতে স্পিকারের কাছে চিঠি দিলে। পরদিন রওশন এরশাদও স্পিকারের কাছে পাল্টা চিঠি লিখেন। একই সঙ্গে পার্টির রওশনপন্থিরা রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারপারসন ঘোষণা করেন। একটি দলে দুই জন চেয়ারপারসন, বিরোধী দলীয় নেতার দাবিদার দুইজন। জাতীয় পার্টির আরো একটি ভাঙ্গন যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন দেবর-ভাবীর নাটকীয় সমঝোতা।
এমনিতে দেবর-ভাবীর সম্পর্ক নিয়ে নানান মজার কথা আছে। কিন্তু জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবীর সম্পর্কটা বরাবরই অম্লমধুর। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোটে থাকলেও জাতীয় পার্টিতে বরাবরই দুটি ধারা ছিল- এরশাদ এবং রওশন এরশাদ। সরকারের সাথে থাকলেও এরশাদ সুযোগ পেলেই সরকারের সমালোচনা করতেন। অবশ্য বেশি বিপ্লব করলে মঞ্জুর হত্যা মামলার তারিখ দিলেই আবার পোষ মেনে যেতেন। তবে রওশন এরশাদ বরাবরই আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত। এই দুই ধারা অনেকদিন ধরেই চলমান এবং দৃশ্যমান। এই লড়াইয়ে জিএম কাদের বরাবরই ভাইয়ের সাথে থেকেছেন।
এরশাদ বেঁচে থাকতে ভাই বড় না বউ বড়, এ নিয়ে বিপাকে পড়তেন। ভাইকে বেশি ক্ষমতা দিলে বউ বিগড়ে যায়, আবার বউকে বেশি ক্ষমতা দিলে ভাই রাগ করে। এরশাদ খুব সতর্কভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতেন। কখনো বউকে, কখনো ভাইকে এগিয়ে রাখতেন। তবে এরশাদ মৃত্যুর আজ জিএম কাদেরকেই পার্টির উত্তরসূরি নির্বাচন করে যান। কিন্তু রওশনপন্থিরা তাকে পুরোপুরি মানতে চাননি। তাই স্পিকারের কাছে চিঠি দেয়ার সুবাদে রওশনপন্থিরা বিদ্রোহ করে বসেন। তবে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতেই শেষ মুহুর্তে নাটকীয় সমঝোতায় টিকে গেল জাতীয় পার্টি। জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান আর সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা থাকবেন। আর রওশন এরশাদ হবেন বিরোধী দলীয় নেতা। রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন রওশনপুত্র সাদ এরশাদ।
Advertisement
ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এমন নাটকীয়ভাবে টিকে গেল কেন জাতীয় পার্টি? আমার ধারণা রওশন এরশাদ আর জি এম কাদেরের জন্যই টিকে গেছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি হলো ‘টাউট’দের আখড়া। কিন্তু দলের মূল দুই নেতাই এর ব্যতিক্রম। জিএম কাদের শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র, রুচিশীল। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার মত চতুর তিনি নন।
একই কথা খাটে রওশন এরশাদের ক্ষেত্রেও। রওশন ও কাদের দলে দুটি ধারার নেতৃত্ব দেন বটে, তবে তারা কখনোই প্রতিপক্ষকে খাটো করে কথা বলেন না। জি এম কাদের সবসময় বলেন, রওশন এরশাদ তার মায়ের মত। সঙ্কট হলেই তিনি ছুটে যান রওশনের কাছে। আসলে দুটি পক্ষ রওশন আর জি এম কাদেরকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টিতে নানান খেলা খেলতে চান। তারা জানেন, জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব এরশাদ পরিবারেই থাকতে হবে। তাই তারা রওশন-কাদেরকে সামনে রেখে খেলাধুলা করেন।
রওশন আর কাদের অর্থাৎ দেবর-ভাবির সম্পর্কের রসায়নেই নির্ভর করছে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ। পেছনের খেলোয়াড়রা বরাবরই চেষ্টা করবে ভেজাল লাগাতে। যদি রওশন-কাদের তাদের কথা উপেক্ষা করে নিজেদের মত সিদ্ধান্ত নিতেক পারেন, তাহলে জাতীয় পার্টির রাজনীতি অনেকদূর যেতে পারবে। নইলে সত্যিই ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এইচআর/এমকেএইচ