বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন যতগুলো প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন দিয়েছে তার মধ্যে ২৪টির দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমেছে। এর মধ্যে প্রিমিয়াম নেয়া কোম্পানিও রয়েছে।
Advertisement
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালিকাভুক্ত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া প্রতিষ্ঠান কিছুতেই ভালো কোম্পানি হতে পারে না। এগুলো নিঃসন্দেহে দুর্বল কোম্পানি।
একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন পাওয়ায় সার্বিক পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তাদের মত।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে মহাধস ঘটলে বাজার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ২০১১ সালের মে মাসে এম খায়রুল হোসেন-কে বিএসইসির চেয়ারম্যান করে বর্তমান কমিশন গঠন করে। এরপর টানা আট বছর খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি পরিচালিত হচ্ছে। এ আট বছরে আইপিও অনুমোদন পাওয়া ২৪টি প্রতিষ্ঠান ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে মিউচ্যুয়াল ফান্ড রয়েছে ১৫টি এবং নয়টি কোম্পানি। এর মধ্যে দুটি কোম্পানি আইপিওতে প্রিমিয়াম নিয়েছে।
Advertisement
প্রিমিয়াম নিয়ে আইপিওতে আসার পরও শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া প্রতিষ্ঠান দুটি হলো- জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও অ্যাপোলো ইস্পাত। ২০১১ সালে আইপিও অনুমোদন পাওয়া জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ২৫ টাকা দামে শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এজন্য ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটি ১৫ টাকা প্রিমিয়াম নেয়। বর্তমানে (৫ সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে সাত টাকা ১০ পয়সায়।
প্রিমিয়াম নেয়ার পরও শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া অপর প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো ইস্পাত ২০১৩ সালে আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এ টাকা উত্তোলনের জন্য কোম্পানিটি ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে প্রিমিয়াম নেয় ১২ টাকা। অর্থাৎ আইপিওতে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয় ২২ টাকায়। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৬০ পয়সায়।
ডিএসইর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, আইপিওতে উচ্চ প্রিমিয়াম নেয়া কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ফেস ভ্যালুর নিচে। তাহলে বোঝেন কোম্পানির মান কী? সব দুর্বল কোম্পানি। গত কয়েক বছরে যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে এসেছে তার মধ্যে হাতে গোনা দু-একটি বাদে কোনো কোম্পানির মান ভালো না।
তিনি বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর আর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মূল কারণ একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদ পাওয়া। এসব কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয়ায় সার্বিক পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাঝ দিয়ে কিছু মানুষ নিজেদের পকেট ভারী করেছেন। আর পুঁজি হারাচ্ছেন পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
Advertisement
শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া বাকি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, ফ্যামেলি টেক্স, ফারইষ্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, তুং হাই নিটিং, সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল, জাহিন স্পিনিং ও অলিম্পিক এক্সেসরিজ। এ সাত প্রতিষ্ঠানই ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে।
জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন ২০১২ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে ৩০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়ছে চার টাকা ৩০ পয়সা। ৩৪ কোটি টাকা উত্তোলন করা ফ্যামেলি টেক্স’র শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে তিন টাকা ২০ পয়সায়। ৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা ফারইষ্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে তিন টাকা ৪০ পয়সা।
তুং হাই নিটিং আইপিও’র মাধ্যমে উত্তোলন করে ৩৫ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে তিন টাকা ১০ পয়সায়। ৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে দুই টাকা ৭০ পয়সা; ১২ কোটি টাকা উত্তোলন করা জাহিন স্পিনিংয়ের শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে আট টাকা ৬০ পয়সা; অলেম্পিক এক্সসরিজের শেয়ারের দাম নয় টাকা ১০ পয়সায় নেমে এসেছে। কোম্পানিটি আইপিও’র মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে।
এছাড়া আরও ১৪ কোম্পানির শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর কাছাকাছি অবস্থান করছে। এর মধ্যে রয়েছে- সেলভো কেমিক্যাল, জিএসপি ফাইন্যান্স, জিবিবি পাওয়ার, ইভিন্স টেক্সটাইল, সেন্ট্রাল ফার্মা, মোজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং, এমারেল্ড অয়েল, ফার কেমিক্যাল, খুলনা প্রিন্টিং, ফারইষ্ট নিটিং, খান ব্রাদার পিপি, ন্যাশনাল ফিড, রিজেন্ট টেক্সটাইল, ইয়াকিন পলিমার, প্যাসেফিক ডেনিমস ও নূরানী ডাইং। কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম ১৫ টাকার নিচে নেমে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা ফ্রড (প্রতারক)। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে পুঁজিবাজারে এমন দুরবস্থা বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যখন নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না, তখন বিনিয়োগকারীদেরকেই নিজের পুঁজি রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা না করে গুটিকয়েক লোকের স্বার্থ হাসিলের সুযোগ করে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের উচিত ওইসব দুর্বল কোম্পানির শেয়ার না কেনা। বিনিয়োগকারীরা টাকা দিয়ে কেন দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কিনবে?
এদিকে ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে রয়েছে- ইবিএল এনআরবি মিউচ্যুয়াল ফান্ড, রিলায়েন্স ওয়ান মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এলআর গ্লোবাল (বিডি) মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এনএলআই ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট বাংলা ফিক্সড ইনকাম ফান্ড, আইসিবি এএমসিএল সোনালী ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এশিয়ান টাইগার সন্ধানী লাইফ গ্রোথ ফান্ড, ভ্যানগার্ড এএমএল বিডি ফাইন্যান্স মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এসইএমএল লেকচার ইক্যুয়িটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড, ভ্যানগার্ড এএমএল রূপালী ব্যাংক ব্যালেন্স ফান্ড, সিএপিএম বিডিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড-১, আইসিবি এএমসিএল ফার্স্ট অগ্রণী ব্যাংক মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও সিএপিএম আইবিবিএল ইসলামীক মিউচ্যুয়াল ফান্ড।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম