পঞ্চম শ্রেণির ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা আর নিতে চায় না প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। জনবল ও অবকাঠামো সংকটে এ পরীক্ষা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী বছর থেকে এটি কার্যকর হতে পারে।
Advertisement
জানা গেছে, পঞ্চম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে ২০০৯ সাল থেকে সমাপনী পরীক্ষা শুরু হলেও ইবতেদায়ি পরীক্ষা চালু হয় ২০১০ সালে। প্রথম দুই বছর বিভাগভিত্তিক ফল দেয়া হলেও ২০১১ সাল থেকে ইবতেদায়ি পরীক্ষার গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফল ও পরীক্ষার সময় আধাঘণ্টা বাড়িয়ে আড়াই ঘণ্টা করা হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) এর আয়োজন করে থাকে। পরীক্ষায় পাসের মাধ্যমে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে থাকে। পাশাপাশি ফলাফলের ভিত্তিতে সারাদেশে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দেয়া হয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর সারাদেশ ৩০ লাখ পরীক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী ও ইবতেদায়ি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকে। নিজস্ব শিক্ষা বোর্ড ও পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে হিমশিম খাচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রশাসনিক কাজ বন্ধ রেখে প্রতি বছর এ পরীক্ষা আয়োজন এবং খাতা মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশ করতে হয়।
জানা গেছে, সমাপনী পরীক্ষা আয়োজনে আলাদা একটি শিক্ষা বোর্ড গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়া ইবতেদায়ি পরীক্ষাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগের অধীনে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
Advertisement
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ের অধীনে কোনো শিক্ষা বোর্ড না থাকার পরও প্রতি বছর ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী ও ইবতেদায়ি পরীক্ষার আয়োজন করতে হচ্ছে। পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়ন ও ফলাফল প্রকাশ করতে হয়। এতে আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ে শেষ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে পঞ্চম শ্রেণির ইবতেদায়ি পরীক্ষাটি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড আয়োজন করে থাকে। এ বোর্ড শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। যেহেতু মাদরাসা বোর্ড আমাদের অধীনে নয়, তবে আমরা কেন তাদের পরীক্ষা আয়োজন করব- এমন প্রশ্ন তুলে সচিব বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মুন্সি শাহাবুদ্দীন আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি এ বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন। দ্রুত তাদের চিঠি দেয়া হবে। আগামী বছর থেকে ইবতেদায়ি পরীক্ষা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজন করবে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ২৬ হাজারের বেশি জাতীয়করণসহ সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫৯০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। অন্যদিকে সারাদেশে প্রায় ১০ হাজার বেসরকারি ইবতেদায়ি মাদরাসা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সুবিধা প্রদান করা হয় না। অথচ প্রতি বছর একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাপনী ও ইবতেদায়ি পরীক্ষার আয়োজন হচ্ছে।
এদিকে, দেশের সব ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা দুই মাসের বেশি আন্দোলন করে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন শিক্ষকরা। ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে রেজিস্ট্রার বেসরকারি প্রাইমারি ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে বিগত সরকারের শাসনামলে ধাপে ধাপে বেতন বৃদ্ধি হতে হতে ২০১৩ সালে ২৬ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়।
Advertisement
সম্প্রতি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা। এতে কিছুটা বিপাকে পড়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দাবি পূরণে এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মৌখিক প্রতিশ্রুতিও দেন আন্দোলনকারী শিক্ষকদের। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে সরকারি সিদ্ধান্ত না থাকায় বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো পরিচালিত হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনীর মতো ইবতেদায়ি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করছে। অথচ মাস শেষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা বেতন পেলেও ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা সেই হারে বেতন না পেয়ে মানবেতন জীবন-যাপন করছেন। এ দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করলেও তাদের শুধু আশ্বাস দেয়া ছাড়া আর কিছুই মেলেনি।
বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির মহাসচিব কাজী মো. মোখলেছুর রহমান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি। সারাদেশের ১৮ হাজার ১৯৪টি স্বতন্ত্র মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা ঢাকায় এসে টানা দুই মাসের বেশি আন্দোলন করেন। এ আন্দোলনে প্রায় ৩০০ শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েন, একজন শিক্ষক মারা গেলেও সরকার আমাদের দাবি মেনে নেয়নি।’
তিনি জানান, সারাদেশে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষকরা সর্বসাকুল্যে ২৫০০ টাকা, সরকারী শিক্ষকরা ২৩০০ টাকা ভাতা পান। বাকি প্রায় আট হাজার ৫০০টি মাদরাসার শিক্ষকরা প্রায় ৩৪ বছর ধরে বেতন-ভাতা পান না। এ কারণে তাদের দুর্বিষহ দিন পার করতে হচ্ছে।
এমএইচএম/এনডিএস/এমএআর/জেআইএম