মতামত

বাংলাদেশের শিক্ষাচিত্র ও নেত্রকোণার অনন্য উচ্চতা

ময়মনসিংহ বিভাগের অন্যতম একটি জেলা ‘নেত্রকোণা’য় এখন প্রায় ২৫ লাখ মানুষের বসতি। এই জেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ, পূর্বে সুনামগঞ্জ ও পশ্চিমে ময়মনসিংহ। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৮০ খিস্টাব্দে হওয়া নেত্রকোণা মহকুমাকে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি নেত্রকোণা জেলা করা হয়। এই জেলা ১০টি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত। এখানে সাক্ষরতার হার ৩৪.৯৪ শতাংশ। তবে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এই জেলার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এখানে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়’। একইসময় মেডিকেল কলেজ চালু হয়েছে। এছাড়া ২৮টি কলেজ, ২৩৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১০৮৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৬০টি মাদ্রাসা রয়েছে এখানে। এখানকার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় (প্রস্তাবিত) দেশের ৪২তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এটির অবস্থান নেত্রকোণা জেলার পৌর শহরের রাজুর বাজার (বারহাট্টা রোড) এলাকায়।

Advertisement

উপাচার্য অধ্যাপক ও লেখক ড. রফিকউল্লাহ খান নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার জন্য সাধনা করে চলেছেন। ৫০০ একর (নির্মাণাধীন) জমি নিয়ে গড়ে উঠছে এটির বিশাল ক্যাম্পাস। বিষয় হিসেবে বাংলা, ইংরেজি, কম্পিউটার সায়েন্স এবং ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স পাঠদান করা হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে আরও বাড়ানো হবে। ২০০ আসন থেকে পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় এটি হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ। বিশ্বব্যাপী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে অচিরেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে সুস্থ মানসিকতা ও উচ্চ মানসম্পন্ন মনন সৃষ্টি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। মুক্তচিন্তার চর্চা, নিরাসক্তভাবে সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য। এসব লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সচিব সাজ্জাদুল হাসান ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নেত্রকোণার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম শ্রেণির বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে সহায়ক হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো সৃজনশীলতার সূতিকাগার। নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রচেষ্টা, নতুন চিন্তা ও আবিষ্কার সমাজকে এগিয়ে নেয় এ ভাবনা আমাদের অস্থি-মজ্জায় লালন করা দরকার।

২.

নেত্রকোণার শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে হলে স্বাভাবিকভাবে সমগ্র দেশ তথা জাতীয় ইতিহাসকে সামনে আনতে হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের প্রথম সরকার কর্মকান্ড শুরু করে। এখন ২০১৯ সাল। এই দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে; পাল্টে গেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি; নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের চিন্তা-চেতনা। পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করেছিল। একাধিক শিক্ষা প্রণালি ছিল তার মূল কারণ।

Advertisement

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’-এ এদেশে চলমান শিক্ষা ক্ষেত্রে নানারূপ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাপনার সমাধানের কথা উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পুরানো ভূত ভর করে। ১৯৭৩ সালে ৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তারও মৃত্যু ঘটে পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বৈরশাসকদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে। বঙ্গবন্ধুর আমলে শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দেয়া হয়; ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতির পিতার আদর্শের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা সরকারের আমলে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়ায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যে সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার যে কথা বলা হয়েছিল তা বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার কাজ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার একটি প্রবন্ধের নাম ‘শিক্ষিত জনশক্তি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত’। ১৯৯৪ সালে লিখিত এই প্রবন্ধে তিনি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করে গড়ে তোলার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তখন থেকেই দেশের উৎপাদনমুখী কর্মকান্ডের সঙ্গে শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। প্রতিটি ছাত্র যাতে তাদের নিজস্ব স্বাভাবিক মেধা-মনন, ক্ষমতা ও প্রবণতা অনুযায়ী পেশা বেছে নিতে পারে তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। সেসময় তাঁর প্রত্যয়দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল- ‘শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা বদ্ধপরিকর।’ উক্ত প্রবন্ধে তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে নিরক্ষরতা দূর করার কথা বলেছিলেন। ছাত্রদের কাজে লাগানোর তাঁর সেই স্বপ্ন রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ভিন্ন আঙ্গিকে সম্পন্ন হয়েছে। উপরন্তু তিনি ফেল করা হতাশ শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভেবেছিলেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দেশের সম্পদ উৎপাদনে ও গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত করার কথা লিখেছেন। সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাদের সমাজের দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ছিল তাঁর লেখায়। দুই দশক আগের এসব ভাবনার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায়।

গত মহাজোট সরকারের অন্যতম কীর্তি জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন। ‘শিক্ষানীতি ২০১০’-এ ছাত্রদের চরিত্র গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষানীতির ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ তিন- অংশে বলা হয়েছে: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলি (যেমন: ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো’ হবে। মূলত শিক্ষা সংক্রান্ত শেখ হাসিনার ভাবনার বাস্তবায়নই হচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতি’২০১০।

আসলে শিক্ষার অপরিহার্যতার দিকে লক্ষ্য রেখেই ২০১০ সালে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে এবং তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে শতভাগ শিশুর ভর্তি, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রতিবছর বিনামূল্যে বই বিতরণ, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষার প্রবর্তন, ঝরে পড়ার হার হ্রাস, ছাত্রীদের অনুপাত বৃদ্ধি প্রভৃতি শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অগ্রগতির সাক্ষর। প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষকদের পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা, ট্রেনিং ও দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে মাল্টিমিডিয়া ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান, কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা, প্রতি উপজেলায় একটি করে বিদ্যালয়কে মডেল বিদ্যালয়ে পরিণত করার কার্যক্রম চলছে। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন, ভর্তি পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল প্রকাশ প্রভৃতি কার্যক্রম জনগণের প্রশংসা অর্জন করেছে। আমাদের জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষা পালন করছে নিয়ামক ভূমিকা। বর্তমানে শিক্ষাখাতে ২০০৯-১৯ পর্বে অনুসৃত নীতি ও সাফল্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বর্তমান শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে দেশে একটি শিক্ষা আইনের-২০১৩ খসড়া প্রণীত হয়েছে। এর ৫১ (১) ধারায় গাইড বই, নোট বই, শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধে উদ্যোগ এবং এক্ষেত্রে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়। ৫৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে শিক্ষকদের যথাযথ বেতন-ভাতা ও মর্যাদা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা; শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে একটি শিক্ষিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলা। অঙ্গীকার পূরণে কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে ৯৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে।

Advertisement

মূলত মানবসম্পদ উন্নয়নে একটি সার্বিক কৌশল গ্রহণ করেছে শেখ হাসিনার সরকার। এ কৌশলের অংশ হিসেবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এবং ব্যক্তি মালিকানা খাত ও সরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা আরও সুদৃঢ় করা হচ্ছে। শিক্ষার বিষয়বস্তু বা কারিকুলামও চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবানুগ করা হয়েছে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা এবং বিভিন্ন পেশায় ও প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ ঢেলে সাজানোর যে কাজ শুরু হয়েছে তা সুচারুভাবে সম্পন্ন করা এবং সারাদেশে এর প্রচলন নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। অপরদিকে রেজিস্ট্রার্ড ও কমিউনিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা স্কেলের প্রারম্ভিক ১০০ শতাংশ প্রদান করা হচ্ছে।

৩.

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে শিক্ষা সেক্টরে অর্জিত উত্তম সব কিছুই অনুসৃত হচ্ছে নেত্রকোণা জেলায়। নেত্রকোণার রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এখানে চর্যাপদের (দ্বাদশ শতাব্দী) চুরাশিজন বৌদ্ধ মহাসিদ্ধদের একজন কাহ্নপাদকে পেয়েছি। উনিশ-বিশ এবং একবিংশ শতাব্দীর বহু বিখ্যাত ব্যক্তির ভিটামাটি এই এলাকায়। এখানকার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বনেদি হিসেবে গণ্য। বর্তমান সরকারের আমলে ঐতিহ্যবাহী ‘দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে’র শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ৩রা জানুয়ারি শিশুদের শিক্ষা দানের জন্যে একটি পাঠশালা স্থাপন করা হয়। পাঠশালাটি পরে এমই স্কুলে রূপান্তরিত হয়। ১৮৮৭ সালে ১লা জানুয়ারি নেত্রকোণা পৌরসভা স্থাপিত হয়। পৌরবাসীর ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার সুযোগ্য ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও ঔপন্যাসিক রমেশ চন্দ্র দত্ত (আইসিএসসিআইই) ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং তারই উপাধি ধরে এর নামকরণ করা হয় ‘দত্ত হাই স্কুল’। বর্তমানে অবকাঠামো, প্রযুক্তিগত, স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পদের দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম অত্যাধুনিক বিদ্যাপীঠ। পাঠদান প্রক্রিয়াতেও প্রতিষ্ঠানটি প্রশংসনীয়।

বর্তমানে শিশু শ্রেণি থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত বালক-বালিকা শাখায় পাঠদান চালু আছে। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যা ৮৬ জন। ২০১৯ সালে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৬০৯ জন। প্রতিবছর জেএসসি ও এসএসসি পাশের হার সন্তোষজনক; প্রায় শতভাগ। বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও সামাজিকভাবে তার মান এখন অনেক উঁচুতে। কেবল প্রাচীন বিদ্যাপীঠের পরিচর্যা নয় নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে নেত্রকোণায়। শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার’ এর মধ্যে অন্যতম। এটি প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে, জমির পরিমাণ ১.১৩ একর। প্রত্যাশী সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ডাক-টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে একীভূত করে দেখা হয়। এই জেলার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও এ দুয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান গুরুত্ব পেয়েছে। ভ্রমণ পিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠান হলো ‘উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি বিরিশিরি’। এই সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটিতে ২০০ আসন বিশিষ্ট অডিটরিয়াম ভবন, গ্যারেজ, গেস্ট হাউজ, হোস্টেল, সীমানা দেওয়াল ও ড্রেন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সকল জেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপে¬ক্স ভবন নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্পের আওতাভুক্ত নেত্রকোণা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ সম্পন্নের পথে। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় শৈলজারঞ্জন সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ। অন্যদিকে বিভিন্ন জেলায় ৩০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) স্থাপন (২য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নেত্রকোণায় একটি কেন্দ্র চালু হয়েছে। অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন আছে ১টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ। ‘১০০টি উপজেলায় ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন (টিএস)’ শীর্ষক প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়াধীন। ‘শেখ রাসেল ট্রেনিং এন্ড রিহেবিলিটেশন সেন্টার ফর দ্য ডিস্টিটিউট চিলড্রেন’ (২য় পর্ব) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নেত্রকোণায় একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে যাচ্ছে।

৪.

প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নেত্রকোণার অগ্রগতি অনন্য। মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রটি অনেক বিশাল। প্রায় ৮০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সরকারি মাত্র সাড়ে সাঁইত্রিশ হাজার। শিক্ষকের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। এর মধ্যে সরকারি হলো এক লাখ ৮২ হাজার। প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ালেখা করে ১ কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রায় ৯৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়ে সরকারি বিদ্যালয়ে। বাকিরা পড়ে বেসরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায়।

সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার প্রবণতা রয়েছে। তবু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আছে প্রাথমিক স্কুলের খাতায়। জাতির মেরুদ- দাঁড়িয়ে আছে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর। তাই প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। গুরুত্ব দেয়া মানে কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করার বিষয়টিও আছে। শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ ও তার যথাযথ প্রয়োগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নও শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। তার চেয়ে বড় কথা এই সকল উদ্যোগ দেখ-ভাল করাও খুব জরুরি। কিন্তু কোন এলাকার বিদ্যালয় ভালো আর কোন এলাকার বিদ্যালয়ে খারাপ অবস্থা চলছে, তা জানা গেলে তো সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নেয়া যাবে। এজন্য শিক্ষা উন্নয়ন সূচক নির্ণয় জরুরি। যার মাধ্যমে সহজেই চিহ্নিত করা যাবে, কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে।

জানা কথা যে, দেশে চলছে ১১ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে এবতেদায়ী এবং কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতিও রয়েছে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের শিক্ষাচিত্র সন্তোষজনক ছিল না। যেমন সিলেট অঞ্চলের শিক্ষাচিত্র ভয়াবহ রকমের খারাপ ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অবস্থার কথা তো সকলেই জানেন। দেখা গেছে, যে এলাকার মানুষ বেশি গরিব, সেই এলাকার প্রাথমিক শিক্ষার হাল ততই করুণ। তবে শিক্ষার অবস্থা খারাপের জন্য কেবল দারিদ্র্যই দায়ী নয়। আরো অনেক কারণ তার পেছনে রয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বৈর শাসকদের দুর্নীতি এর অন্যতম কারণগুলোর একটি। স্বৈরশাসকদের সময় ৯০ লাখ শিক্ষার্থীর অবস্থাই অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীই ছিল খারাপের কবলে।

আশার কথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আমলে নেত্রকোণা, ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের শিক্ষাচিত্র উন্নত হয়েছে। বরিশাল ও চট্টগ্রামের অবস্থা তারপরে। পূর্বেই বলা হয়েছে সবচেয়ে খারাপ ছিল সিলেট বিভাগের। জেলাওয়ারি হিসাব করলে নারায়ণগঞ্জের অবস্থান সবচেয়ে উপরে আর সুনামগঞ্জের অবস্থান সবচেয়ে নিচে ছিল। তবে নানামুখী পদক্ষেপের পর সার্বিক বিবেচনায় দশটি ভালো জেলা হলো নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, ঢাকা, বাগেরহাট, গাজীপুর, নবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, ফেণী, মানিকগঞ্জ ও রাজশাহী। আর এখনও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার সুনামগঞ্জ, বান্দরবান, মৌলভীবাজার, সিলেট, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, গাইবান্ধা, শেরপুর জেলাকে। একথা ঠিক যে, সকল এলাকার শিক্ষাচিত্র সমান হওয়ার কথা নয়। ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক অবস্থাও এর জন্য দায়ী। পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাওয়া কী কষ্টকর, তা ওই এলাকার মানুষ ছাড়া আর কেউ জানে না। আবার সুনামগঞ্জে হাওরের মধ্যে স্কুলে যাওয়ার প্রবণতা কম কারণ ওই যাতায়াত সমস্যা। তাই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হলে, এলাকাভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে। যে অঞ্চলের স্কুলের অবস্থা বেশি শোচনীয় সে এলাকার সমস্যা নিরসনকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। এভাবেই প্রাথমিক শিক্ষার সংকট দূর করে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সফলতা আসতে পারে।

প্রাথমিক শিক্ষার সংকট দূর করার জন্যই নেত্রকোণা জেলায় ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর’ শিক্ষা সেক্টরে ব্যাপক বরাদ্দ নিয়ে কাজ করছে। যেমন প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩,৫৮৩ টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ২১৮টি ওয়াসা ব্লক নির্মাণের কাজ করেছে। চলমান রয়েছে ৩,৪১০ টি গভীর নলকূপ ও ৫০টি ওয়াসা ব্লক নির্মাণের কাজ। অন্যদিকে ‘শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর’ বিগত ১০ বছরে বাস্তবায়িত উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ২০১১-১২ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ‘সরকারি বিদ্যালয়বিহীন ৩১৫টি উপজেলা সদরে নির্বাচিত বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহকে মডেল স্কুলে রূপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে একাডেমিক ভবন নির্মাণ (২০০০ স্কুল) প্রকল্প পরিচালনা করেছে। আবার প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি ৭০টি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজসমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প(২য় পর্যায়) এর ২টি চলমান এবং ২টির দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ‘নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন (৩০০০ স্কুল)’ ও ‘নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন (৩০০০ স্কুল)’ শীর্ষক প্রকল্পের আসবাবপত্র সরবরাহের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। আসবাবপত্র সরবরাহসহ নির্মাণ করা হচ্ছে বেসরকারি মাদ্রাসার একাডেমিক ভবন। ‘তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক ১২টি প্রকল্প চূড়ান্ত এবং ১৭টি চলমান রয়েছে। রাজস্ব বাজেটের আওতায় (সরঃ ও বেসঃ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩৫টি নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও তার মধ্যে ১২টি চূড়ান্ত ও ২৩টি চলমান রয়েছে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কার ও মেরামত কাজ চলছে যার মধ্যে ৫৪টি চূড়ান্ত। এছাড়া নেত্রকোণা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় বিগত ১০ বছরে বাস্তবায়ন করেছে বিচিত্র উন্নয়মূলক কার্যক্রম। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১৫০০ বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

৫.

বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি দরিদ্র-ক্ষুদ্র-জনবহুল এবং উন্নয়নশীল দেশ। নেত্রকোণা তারই একটি জেলা। এ জেলার আর্থ সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এবং সেখানকার মানুষের জীবনের উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা শব্দটি ব্যাপকভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কাজেই ব্যক্তি-গৃহ-পরিবার-সমাজ-দেশ তথা জাতীয় উন্নয়নের নিমিত্তে নেত্রকোণার শিক্ষার আরো উন্নয়ন করতে হবে একথা যেমন সত্য তেমনি শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি সুনির্দিষ্ট করাও অপরিহার্য। কারণ মানব জাতির কল্যাণকর, শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি শিক্ষার মূল লক্ষ।

অন্যদিকে যথার্থ ও ভারসাম্যময় শিক্ষা পদ্ধতি একটি দেশের অগ্রগতির চালিকা শক্তি। এজন্য দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্পৃক্ত শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রণীত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ সহায়তা করছে মানবজাতিকে মঙ্গলময় কর্মকান্ডের সংযুক্ত হতে। আধুনিক জীবনে শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতি তার প্রাত্যহিক জীবনও চিন্তা করতে পারে না। শিক্ষাই কেবল তার বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তুলতে পারে। এজন্য শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতির নতুন আবিষ্কার ও প্রয়োগ একটি অন্যতম অনুষঙ্গ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।’ তিনি আরো বলেছেন ‘শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।’ মানব শিশুর জন্মের পর থেকে ক্রমাগত এবং অব্যাহত পরিচর্যার মাধ্যমে তার দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে নানা সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তার মানসিক বিকাশ হয়। উন্নত মানসিক বিকাশের ক্রমচর্চার মধ্যে দিয়ে নৈতিকতার পরিগঠনের মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধি ঘটে। এজন্য বলা হয়ে থাকে দেহ, মন ও আত্মার সুসামঞ্জস্য বিকাশই শিক্ষা। এক কথায় পরিপূর্ণ মানব সত্তাকে লালন করে, দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে, নিজেকে জাতির উপযোগী, যোগ্য, দক্ষ, সার্থক ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা। শিক্ষা মানব জীবনের এক মূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদ কখনই খোয়া যায় না বা বিলুপ্ত হয় না। বেঁচে থাকার জন্য, নিজেকে অভিযোজিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা অপরিহার্য। নেত্রকোণা জেলা শিক্ষা সেক্টরে যে উচ্চতায় উপনীত হয়েছে তা সেখানকার মানুষের ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ঠ।

লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস