মতামত

খেলাপি ব্যাধি

হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ ঋণ জালিয়াতি কোম্পানিদের আরেকবার ব্যবসার সুযোগ দিতে উদ্যোগী হয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। কোন বড় শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বড় বিপদে পড়লে, অনাদায়ী ঋণের চাপে পড়লে নিশ্চয়ই সরকার তাকে নীতিগত সহায়তা দিবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো হলমার্ক বা বিসমিল্লাহ গ্রুপ কি সত্যিকার অর্থে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান? নাকি এদের কাজই হলো ব্যবসায় ঢুকে প্রভাবশালী আর দুর্নীতিবাজদের হাত করে ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লোপাট করা?

Advertisement

এসব প্রশ্নের সুরাহা করেই অর্থমন্ত্রী হলমার্ক, বিসমিল্লাহ্দের মত ব্যবসায়ীদের দিকে হাত বাড়াবেন বলে মনে করি। তবে তিনি একটি সত্য কথা বলেছেন যে, সরকার নতুন করে কোনো ব্যবসায়ী সৃষ্টি করতে পারবে না।

সরকারতো আসলে ব্যবসায়ী সৃষ্টি করেওনা। সরকারের নীতি সহায়তা, আর্থিক নীতি মালা ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে যার মাধ্যমে উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়। বর্তমান সময়টিতে উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রয়াস সেভাবে চোখে পড়ছে না।

ছয় বছর পার হলেও হলমার্কের ঋণ জালিয়াতি করা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ফেরত আনতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক। বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ব্যাংক ভবন করপোরেট শাখা থেকে ফান্ডেড ৩০৭ কোটি ৩৮ লাখ এবং নন ফান্ডেড ২৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকাসহ বিভিন্ন শাখা থেকে মোট ১ হাজার ২শ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি করে। যার মামলা এখনো চলমান রয়েছে। এবং সংসদেই জানানো হলো যে, বাংলাদেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১৮৩ কোটি টাকা।

Advertisement

আ হ ম মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে তিনি ঋণ খেলাপিদের প্রতি একটা কোমল দৃষ্টি দিচ্ছেন। কয়েক মাস আগে সবাইকে চমকে দিয়ে ঘোষণা দিলেন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরে অর্থ পরিশোধ করতে পারবে ঋণ খেলাপিরা। তার এই উদ্যোগ ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়ে। এমনকি খোদ ব্যবসায়ীরাই বলা শুরু করেন যে, এর মাধ্যমে ভাল ব্যবসায়ীরা মনোবল হারাবেন, খারাপরা ব্যবসায় আসবে ব্যাংকের টাকা লুটের জন্য। অর্থমন্ত্রীর এই উদ্যোগ আদালতের নির্দেশে বর্তমানে স্থগিত অবস্থায় আছে।

খেলাপী ঋণ একটা সংস্কৃতি। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে একটা ব্যবসায়ী চক্র ঋণ নেয় সেটা ফেরত দেবে না জেনেই। আর খেলাপি ঋণ ফেরত পাবার ক্ষেত্রে সরকারের নমনীয় নীতির কারণেই ঋণ আদায় হয় না। যারা ঋণ খেলাপি তারা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী, বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তাদের যোগাযোগ।

এই প্রভাবের কারণেই অনেক ব্যাংক ঋণ দেয়ার সময় ঝুঁকি পর্যালোচনা ছাড়াই তাদের আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দেয়। এসব ঘটনা বেশি ঘটে সরকারি ব্যাংকের বেলায়। সরকার উদ্যোক্তাকে সাহায্য করতে চাইলে ক্ষতি কী? ক্ষতি ছিল না, যদি ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল হত। আমরা জানি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য খারাপ। অস্বাস্থ্যের একটি বড় কারণ অনাদায়ী ঋণ বা খেলাপি, যার পোশাকি নাম ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেট’ বা এনপিএ।

আপাতদৃষ্টিতে ঋণ সংস্কৃতি। যে ঋণ সময় মতো শোধ হয় না, ব্যাংক অনেক সময়েই তা পুনঃতফসিল করে। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বিলম্বিত করে ঋণগ্রহীতাকে সুযোগ দেয়, দেরিতে হলেও যেন সে টাকাটা ফেরত দেয়। এই পুন:তফসিল করা ঋণ আর নন পারফরমিং এসেটের হিসাব দেখানো হয় না। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, ব্যাংকগুলির পুন:তফসিল করা ঋণের একটি বড় অংশ সময় মতো শোধ হয় না। আর এই বাস্তবটি হিসাবে ধরলে প্রকৃত অর্থে খেলাপি ঋণের অংশ আরও অনেক বেশি হবে।

Advertisement

ব্যাংকের কারবারে মূল কথাটি সহজ। ঋণ সময় মতো শোধ না হলে সেই কারবারের স্বাস্থ্য ফিরতে পারে না। বহু বছর ধরে সরকারি উদ্যোগে টাকা ঢেলে ঢেলে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু লাভ হয়নি। এই ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া মানে ফুটো পাত্রে পানি ঢালা। ভালর দিক এই যে, অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণীকে আর কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে না। আগামী বাজেটে বরাদ্দ থাকবে না তাদের জন্য। তাই এসব ব্যাংককে নিজেদের টাকায় চলতে হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংককে অর্থায়ন জনসাধারণের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয়। ব্যাংক তার গ্রাহকের সাথে ব্যবসা করে। যে কারণেই ঋণ অনাদায়ী হোক দায় তার। সেই দায় সরকারের উপর তথা করদাতাদের উপর চাপানো অন্যায়। এতদিন সেই অন্যায়টি হয়ে এসেছে। অর্থমন্ত্রী যদি এটি বন্ধ করতে পারেন, তবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এবং এটি হবে ইতিবাচক সংস্কারের পক্ষে বড় পদক্ষেপ।

আরেকটি দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ঋণ শোধের নিয়ম কঠোর হওয়া আবশ্যক, যাতে ‘পুন:তফসিল’-এর নামে যেন খেলাপিরা পার পেয়ে না যায়। এখানেই মূল আর্থিক নীতি সংস্কারের প্রশ্ন। ব্যবসায়ে ব্যর্থ হলে দেউলিয়া হতে পারে, কিন্তু ঋণ শোধ না করলে চলবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দূর করবার সাহস তিনি দেখাবেন কিনা জানিনা, জানিনা বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে কোন কোন মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করবেন কিনা। কিন্তু আমরা জানি খেলাপি ঋণ এক ব্যাধি। ঋণ খেলাপির কাছ থেকে টাকা আদায় না করে তাকে ব্যবসায় ফিরিয়ে আনলে সেই ব্যাধির নিরাময় হবে না।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/জেআইএম