বিশেষ প্রতিবেদন

উড়োজাহাজ লিজের সঙ্গে জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

ইজিপ্ট এয়ারের ত্রুটিপূর্ণ দুটি এয়ারক্রাফট লিজে এনে যারা কমিশন খেয়ে অসম চুক্তি করেছেন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্যদিকে ওই সময় যারা কোনো দায়িত্বে ছিলেন না তাদের চাকরিচ্যুত ও বরখাস্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে মূল অপরাধীরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিরপরাধ ব্যক্তিরা পাচ্ছেন শাস্তি।

Advertisement

৩ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) পরিচালনা পর্ষদের সভায় ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজে আনা এয়ারক্রাফট দুটি ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়ায়ও অনিয়ম হয়েছে- এমন অভিযোগে সংস্থার পরিচালক প্রকৌশল খন্দকার সাজ্জাদ রহিমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। যিনি বছর খানেক আগে বিমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান।

সেই সঙ্গে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স’র প্রধান প্রকৌশলী জি এম ইকবালকে। এ ঘটনার পর থেকে বিমানের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই বিষয়টির নেতিবাচক দিক তুলে ধরে বলেন, প্রকৃত অপরাধী তারা অসম চুক্তির মাধ্যমে যারা উড়োজাহাজগুলো লিজ নেন।

বিমানের সাবেক এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিমানের স্বার্থ চিন্তা না করে নিজেদের পকেট ভারী করতে ২০১৪ সালে ওই ত্রুটিপূর্ণ উড়োজাহাজগুলো সংগ্রহে চুক্তি করা হয়। তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন?

Advertisement

জানা গেছে, একটি অসম চুক্তি হয় ২০১৪ সালের মার্চে। সে সময় বিমান পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ। তার আগ্রহে সমস্যা জর্জরিত এয়ারক্রাফট দুটি লিজে আনা হয়। অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই লিজ বাণিজ্যে অবৈধভাবে সম্পৃক্ত করা হয় বিমান বাহিনী থেকে আগত বিতর্কিত পাইলট ক্যাপ্টেন শামীম নজরুলকে। নিয়মানুযায়ী ওই সময় শামীম নজরুল এয়ারক্রাফট লিজ কমিটিতে থাকার কথা নয়। তিনি ছিলেন ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং। লিজ কমিটিতে থাকার কথা ছিল চিফ অব টেকনিক্যাল অথবা সংশ্লিষ্ট বিভাগের মনোনীত অন্য কেউ। ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিংকে কোনোভাবেই লিজ কমিটিতে রাখার বিধান নেই বলে জানান বিমান সংশ্লিষ্টরা। মূলত উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান, ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল ও ক্যাপ্টেন ইশরাতই লিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে বিশেষ সুবিধা নেন।

বিতর্কিত ওই লিজ বাণিজ্যে চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের কাছের লোক হিসেবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তৎকালীন পরিচালক প্রকৌশল উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান। তিনি এখনও বিমানে স্পেয়ার পার্টস সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করছেন।

অভিযোগ রয়েছে, লিজ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বিতর্কিত ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল গত ৮ মে ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে একটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ ভুুলে ল্যান্ডিং করতে গিয়ে ক্রাশ করেন। এ বিষয়ে ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দর থেকে পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদনে নজরুলকে দায়ী করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তিনি চাকরিতে বহাল। এত বড় দুর্ঘটনার নায়ক হয়েও কীভাবে পার পাচ্ছেন এবং কী কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়নি এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি।

তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, এত বড় দুর্ঘটনায় যিনি ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন তার ভুল ল্যান্ডিংয়ের কারণে যদি এয়ারক্রাফট ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ধ্বংস হয় সেজন্য অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া উচিত। আমাদের দেশে এসবের প্র্যাকটিস নেই বলেই বারবার অন্যায় অনিয়ম সংগঠিত হচ্ছে।

Advertisement

ইজিপ্ট এয়ারের লিজ বাণিজ্য বিষয়ে তিনি বলেন, এমন ত্রুটিপূর্ণ এয়ারক্রাফট দুটি কীভাবে বিমান বহরে যুক্ত হলো, কারা এই অসম চুক্তি করেছেন। এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি। তদন্তে কারও গাফিলতি, অবহেলা ও কমিশন বাণিজ্য ধরা পড়লে বর্তমান বোর্ড এবং মন্ত্রণালয়ের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।

বিমান সূত্রে জানা গেছে, ইজিপ্ট এয়ার থেকে আনা দুটি উড়োজাহাজ নেয়ার পূর্ব শর্ত ছিল উড়োজাহাজগুলো যে অবস্থায় লিজে আনা হয়েছে, ঠিক একই অবস্থায় ফেরত দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ কারণেই এটি একটি অসম চুক্তি। কারণ পাঁচ বছর ব্যবহারের পর কোন উড়োজাহাজের অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে না। এটির আয়ুষ্কাল কমে যায় বিভিন্ন যন্ত্রাংশও পুরনো হয়। এমন প্রেক্ষাপটে লিজ প্রদানের সময়কার অবস্থায় উড়োজাহাজ ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের এমন কঠিন শর্তের চুক্তিতে জড়িতরা স্বাক্ষর করেন।

অভিযোগ উঠেছে, ওই সময় মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্যই ছিল মূল উদ্দেশ্য। বিমানের স্বার্থ মোটেও দেখা হয়নি। ফলে কিছুদিন না যেতেই এয়ারক্রাফটগুলো ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কঠিন ও অসম চুক্তির বেড়াজালে পড়ে বিমান। এদিকে দীর্ঘ সময় ভিয়েতনামের বিমানবন্দরে পড়ে থাকে বিকল এয়ারক্রাফটগুলো। অসম চুক্তির কারণে সেগুলো আর ফেরত দেয়ার উপায় ছিল না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের। সম্প্রতি অনেক কষ্টে একটি ফেরত দেয়া সম্ভব হয়েছে। আরেকটি কবে ফেরত দেয়া সম্ভব সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

বিমানের একটি সূত্রে জানা গেছে, ত্রুটিপূর্ণ উড়োজাহাজ দুটির ভাড়া হিসেবে বছরে ১২০ কোটি টাকা হারে গচ্চা দেয়া হয়েছে। গড়ে এক বছর চালানো যায়নি বিমানগুলো। প্রশ্ন উঠেছে, বিমানের এত বড় সর্বনাশের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ধরা হচ্ছে না। অথচ পাঁচ বছর পর উড়োজাহাজ ফেরত দেয়ার গাফিলতির অভিযোগে কারও কারও চাকরি যাচ্ছে।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হলো তিনি কোনো জবাব দেননি।

উল্লেখ্য, মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে ৫ বছরের চুক্তিতে ড্রাই লিজে দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ সংগ্রহ করে বিমান। ২০১৪ সালের মার্চে একটি উড়োজাহাজ (রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইসএল, কনস্ট্রাকশন নং ৩২৬৩০) বিমানবহরে যু্ক্ত হয়। অন্য উড়োজাহাজটি (রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইসকে, কনস্ট্রাকশন নং ৩২৬২৯) যুক্ত হয় একই বছরের মে মাসে। চুক্তি অনুসারে উড়োজাহাজ দুটি না চললেও মাসে বিমানকে ১১ কোটি টাকা করে দিতে হচ্ছে।

২০১৪ সালে বিমানবহরে যু্ক্ত হওয়ার এক বছর পরই লিজে আনা বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজটির (রেজিস্ট্রেশন নং এস২-এএইসএল, কনস্ট্রাকশন নং ৩২৬৩০) একটি ইঞ্জিন বিকল হয়। পরে ইজিপ্ট এয়ার থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৮ লাখ টাকায় (১০ হাজার ডলার) ভাড়ার ইঞ্জিন দিয়ে সচল করা হয় উড়োজাহাজটি। নষ্ট ইঞ্জিনটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয় লন্ডনভিত্তিক ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে। সেই ইঞ্জিন মেরামত করে ফেরত আনার আগেই তিন বছরের মাথায় আবারও নষ্ট। তখনও ইজিপ্ট এয়ার থেকে মাসিক ৮ লাখ টাকায় ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। বিকল ইঞ্জিনটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয় ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের কাছে। দীর্ঘসময়ের চেষ্টার পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে লিজে আনা দুটির একটি বিমান ইতোমধ্যে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছে।

আরএম/জেএইচ/পিআর