দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা সম্প্রতি ব্রা বা বক্ষবন্ধনী ছাড়াই পোশাক পরা ছবি অনলাইনে প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশটির নারীদের মধ্যে ক্রমশই ‘হ্যাশট্যাগ নো ব্রা’ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে।
Advertisement
দেশটির জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও গায়িকা সিওলি ইনস্টাগ্রামে এমন একটি ছবি পোস্ট করার পর এই বক্ষবন্ধনীমুক্ত আন্দোলন বা ব্রা লেস মুভমেন্ট দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ইনস্টাগ্রামে সিওলির রয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন অনুসারী।
এরপর থেকে সিওলি বক্ষবন্ধনীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি প্রতীকে পরিণত হন; যার মাধ্যমে নারীরা একটি বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান যে, ব্রা বা বক্ষবন্ধনী পরা না পরা একজন নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়।
বক্ষবন্ধনী মুক্ত আন্দোলন
Advertisement
তবে অনেকের সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও অনেক নারী ও পুরুষের কাছ থেকে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার শিকারও হয়েছেন সিওলি। সমালোচনাকারীরা তাকে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টাকারী এবং উসকানিদাতা বলে অভিযোগ করেন।
অনেকে মনে করেন, তিনি নিজের নামডাক কামানোর উদ্দেশ্যে নারী আন্দোলনকে ব্যবহার করছেন। একজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী ইন্সটাগ্রামে লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে পারি যে, ব্রা পরা না পরার ব্যাপারটা আপনার ইচ্ছা, কিন্তু তিনি সবসময়ই আটোসাঁটো জামা পরে ছবি তোলেন, সবসময়ে তিনি এটা না করলেও পারেন।’
একজন লিখেছেন, ‘ধিক্কার তোমাকে। তুমি কি এভাবে গির্জায় যেতে পারবে? তুমি কি তোমার বোনের স্বামী বা তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে যেতে পারবে? এতে শুধু পুরুষরাই নয়, নারীরাও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।’
সম্প্রতি হাওয়াসা নামের আরেকজন বিখ্যাত গায়িকার ছবি এই হ্যাশট্যাগ নো ব্রা আন্দোলনকে আবার আলোচনায় তুলে এনেছে।
Advertisement
ইচ্ছার স্বাধীনতা
হংকংয়ের একটি কনসার্ট থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে ফেরার পথে বক্ষবন্ধনী ছাড়া সাদা টি-শার্ট পরা অবস্থায় তার ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়। এরপর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ নারীদের মধ্যেও এই আন্দোলনটি ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে দেশটির নারীদের মধ্যে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
২০১৮ সালে ‘এস্কেপ দি কর্সেট’ নামের আন্দোলন হয়েছিল দেশটিতে, যখন অনেক নারী তাদের লম্বা চুল কেটে ফেলেন এবং প্রসাধনী ছাড়া বাইরে বের হতে শুরু করেন। সেসব ছবিও তারা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন।
এই আন্দোলনের মূল শ্লোগানটি এসেছিল নারীদের অবাস্তব সৌন্দর্য চর্চার বিরুদ্ধে, যে চর্চ্চা করতে গিয়ে নারীরা মেকআপের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। অনেক নারী বিবিসিকে বলেছেন যে, তারা মনে করেন, এই দুটি আন্দোলনের মধ্যে অবশ্যই যোগসূত্র আছে এবং যেভাবে এ দুটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, সেটা নতুন ধরনের আন্দোলনের সূচনা করছে।
গেজ রেপ বা চোখ দিয়ে ধর্ষণ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা পুরুষ আধিপত্যের সংস্কৃতি, যৌন সহিংসতা এবং বিশ্রামকক্ষ ও জনসমাগমের স্থানে গোপন ক্যামেরার ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। ২০১৮ সালে দেশটিতে নারীদের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ ঘটে, যেখানে হাজার হাজার নারী সিউলের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন এবং গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর দাবি জানান।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ার কোন কোন নারী বিবিসিকে বলেছেন, তারা এখন বিষয়টি নিয়ে অনেকটা দ্বিধান্বিত। কারণ তারা বক্ষবন্ধনী মুক্ত আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, কিন্তু জনসম্মুখে নিজেরা বক্ষবন্ধনী ছাড়া যেতে সাহস পাচ্ছেন না। তাদের আশঙ্কা মানুষজন হয়তো তাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।
২৮ বছর বয়সী জিয়ঙ সিয়ঙ-ইয়ুন ‘নো ব্রাব্লেম’ নামে একটি তথ্যচিত্রের নির্মাণ দলের সদস্য ছিলেন।তথ্যচিত্রটি বক্ষবন্ধনী ছাড়া বাইরে যাওয়া নারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সিয়ঙ-ইয়ুন বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি এই প্রকল্পটি শুরু করেন, যেটি করার সময় তারা নারীদের প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আমরা মনে করি যে, ব্রা পড়া স্বাভাবিক একটা ব্যাপার?
পছন্দ করার অধিকার
যদিও তিনি মনে করেন, নারীদের এই বিষয়টি নিয়ে জনসমক্ষে আলোচনা করার বিষয়টি ভালো। তবে তিনি এটাও বিশ্বাস করেন যে, বেশিরভাগ নারী এখনো এটা ভেবে লজ্জাবোধ করে যে জামার ওপর দিয়ে তাদের স্তনবৃন্ত ফুটে উঠবে।
‘তারা জানে যে, এখনো দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্রা ব্যবহার করাটা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করা হয় এবং এ কারণেই তারা ব্রা পড়তে চায়।’
২৪ বছর বয়সী পার্ক আই-সেউল দক্ষিণ কোরিয়ার একজন মডেল; যিনি ইতিবাচক শারীরিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। গত বছর তিনি একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন, যেখানে তাকে কোন বক্ষবন্ধনী ছাড়া রাজধানী সিউলে তিনদিন ধরে চলাফেরা করতে দেখা যায়। ওই ভিডিওটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, ২৬ হাজার মানুষ সেটি দেখেছেন।
তিনি বলছেন, তার অনেক অনুসারী এখন মধ্যবর্তী পন্থা হিসাবে ফিতা যুক্ত ব্রার পরিবর্তে নরম কাপ ব্রালেট ব্যবহার শুরু করেছেন।
‘আমার একটি ভুল ধারণা ছিল যে, যদি আমরা ফিতা যুক্ত বক্ষবন্ধনী না পরি, তাহলে আমাদের স্তন ঝুলে যাবে এবং খারাপ দেখাবে। কিন্তু আমি ওই ভিডিওটি তৈরি করার পর থেকে আমি আর সেগুলো পরি না। এখন আমি গরমের দিনগুলোয় ব্রালেট পড়ি, আর শীতের দিনগুলোয় কোন বক্ষবন্ধনীই পরি না।’
তবে আন্দোলন শুধু মাত্র রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ নয়। এই আন্দোলন অনুপ্রাণিত করেছে ডেইগুর ২২ বছর বয়সী উদ্যোক্তা এবং ভিজুয়াল ডিজাইনার নাহয়ুন লিকেও। তিনি কেইমইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স প্রজেক্টের অংশ হিসেবে ইয়াপ্পি নামের একটি পপ-আপ ব্রান্ড শুরু করেছিলেন। গত মে মাস থেকে তিনি এই ব্রান্ডের নামে স্তনবৃন্ত ঢেকে রাখার প্যাচ বিক্রি করতে শুরু করেছেন।
জেওল্লানাম-ডু প্রদেশের ২৮ বছর বয়সী ডা-কিয়ুং বলছেন, তিনি গায়িকা ও অভিনেত্রী সিওলির ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং শুধুমাত্র অফিসে যাবার সময় তিনি বক্ষবন্ধনী পরে যান, যখন বস সামনে থাকে। কিন্তু ছেলে বন্ধুর সামনে যাবার সময় আর সেটি পরেন না।
‘আমার বয়ফ্রেন্ড বলেছে, যদি আমি বক্ষবন্ধনী পড়ে স্বস্তি বোধ না করি, তাহলে আর সেটি পরার দরকার নেই।’ তাদের বক্তব্য হলো, নারীরা কি পরবেন আর পরবেন না, সেটা বাছাই করার স্বাধীনতা তাদেরই।
কিন্তু বক্ষবন্ধনী পরার ব্যাপারে গবেষণা কি বলছে? বক্ষবন্ধনী ব্যবহার না করলে কি স্বাস্থ্যের সমস্যা হয়?
ড. ডেইড্রে ম্যাক গি একজন ফিজিওথেরাপিস্ট এবং ইউনিভার্সিটি অফ উলনগোংয়ের ব্রেস্ট রিসার্চ অস্ট্রেলিয়ার সহ-পরিচালক। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, নারীরা কি পরবেন, সেটা ঠিক করার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু আপনার স্তন যদি অনেক ভারী হয়ে থাকে এবং সেজন্য শরীরে যদি যথেষ্ট সাপোর্ট না থাকে, তাহলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সেটার প্রভাব পড়তে পারে, যার মধ্যে রয়েছে গলা এবং শরীরের পেছনের অংশ।
‘বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের শারীরিক গঠনের পরিবর্তন হয়, চামড়ায় পরিবর্তন আসে এবং এ ধরনের প্রাকৃতিক সাপোর্টও কমে আসে।’
‘যখন নারীরা এ জাতীয় সাপোর্ট ছাড়া ব্যায়াম করেন, তখন স্তন নড়াচড়া করে। তখন স্পোর্টস ব্রা ব্যবহার করলে স্তনের ব্যথা কমাতে পারে, সেই সঙ্গে তাদের পেছনে ও গলায় ব্যথা হওয়া ঠেকাতে পারে।’
‘একইভাবে, আপনার স্তন দেখতে কেমন দেখাচ্ছে বা নড়াচড়া করছে, এ নিয়ে যদি বিব্রত হন বা আত্মসচেতন হন, তাহলে আপনিও অসহায় আচরণের ভেতর দিয়ে যাবেন। যে নারীদের স্তন কেটে ফেলতে হয়েছে, তাদের অনেককে আমি পরামর্শ দেবো বক্ষবন্ধনী ব্যবহার করার জন্য, যাতে তাদের আচরণ আর আত্মবিশ্বাসে সমস্যা না হয়।’
‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, এমনকি যে নারীদের স্তন থাকে না, যেমন ধরুন অপারেশন করে স্তন কেটে ফেলার মতো ঘটনার পরেও, অনেক নারী ওই জায়গাটি ঘিরে রাখতে চান, যেহেতু স্তন আমাদের লিঙ্গ পরিচয়েরও অন্যতম অংশ।’
ইউনিভার্সিটি অফ পোর্টসমাউথের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. জেনি বারবেজ বলছেন, বক্ষবন্ধনী ব্যবহার করে যে নারীরা অস্বস্তি বোধ করেন বা ব্যথা বোধ করেন, তার কারণ আসলে ‘ঠিক মাপের বক্ষবন্ধনী’ ব্যবহার না করা।
‘আমাদের গবেষণা দল যতটা জানে, কোন গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় পাওয়া যায়নি যে, বক্ষবন্ধনী ব্যবহারের সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের সম্পর্ক আছে।’ তবে এটাই প্রথম ঘটনা নয় যে, নারীরা বক্ষবন্ধনীর বিপক্ষে আন্দোলন করেছেন।
১৯৬৮ সালে মিস আমেরিকা সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভের পর ‘ব্রা বার্নিং ফেমিনিস্ট’ বাক্যটির জন্ম হয়, যার মানে বক্ষবন্ধনী পোড়ানো নারীবাদীরা। সেই আন্দোলনের সময় নারীরা যেসব জিনিস আবর্জনার বাক্সে ছুড়ে ফেলেন, তার মধ্যে ছিল বক্ষবন্ধনীও, যেটিকে তারা নারীদের দমন করার একটি প্রতীক বলে মনে করতেন। যদিও তারা আসলে কখনোই বক্ষবন্ধনী পোড়াননি।
এরপর থেকে ‘বক্ষবন্ধনী পোড়ানো’ শব্দ দুটি নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। চলতি বছরের জুন মাসে সুইজারল্যান্ডের কয়েক হাজার নারী বেতনের সমতা, যৌন হয়রানি আর সহিংসতার প্রতিবাদে আন্দোলনের অংশ হিসাবে তাদের অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন, বক্ষবন্ধনী পোড়ান এবং সড়ক অবরোধ করেন।
বিশ্বজুড়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে ১৩ অক্টোবরকে ‘নো ব্রা’ বা ‘বক্ষবন্ধনীহীন দিবস’ বলে পালন করা হয়। কিন্তু গত বছর ফিলিপিন্সের নারীরা ওই দিনটিকে বৃহত্তর লিঙ্গ সমতার দিন হিসাবে পালনের আহবান জানান।
সাংবাদিক ভেনেসা আলমেদা বলছেন, ‘নো ব্রা ডে’ হচ্ছে আমাদের নারীত্ব এবং একজন নারী হিসাবে স্বীকৃতির দিবস। ‘বক্ষবন্ধনী তুলে ধরছে কিভাবে নারীকে দাসত্বের মধ্যে আটকে রাখা হচ্ছে,- তিনি বলছেন।
আন্দোলনকারীরা এ বছর আরো একধাপ এগিয়ে স্তনবৃন্ত নিয়ে রাখঢাকের ব্যাপারে নারী ও পুরুষের মধ্যে দ্বিমুখী আচরণের বিষয়টি সামনে তুলে এনেছেন। ২০১৪ সালে নেটফ্লিক্স একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল ‘ফ্রি দ্য নিপল’। সেখানে দেখানো হয় নিউইয়র্কের একদল তরুণী নারীদের স্তন নিয়ে অপরাধ এবং রাখঢাকের ব্যাপারে আন্দোলন করছেন।
সেটা থেকেই বিশ্ব জুড়ে ‘ফ্রি দ্য নিপল’ আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েদের শরীর নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে বিধিনিষেধের কথা শোনা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাম্প্রতিক ‘নো ব্রা’ আন্দোলন সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে এসেছে। যে নারীরা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি প্রমাণ করছে যে, দক্ষিণ কোরিয়ায় এখনো সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
দেশটির অনেক নারীর কাছে ‘ব্যক্তি স্বাধীনতার’ ব্যাপারটি এখন জরুরি একটা ব্যাপার। দক্ষিণ কোরিয়ার নারীদের মধ্যে যেভাবে আন্দোলনটির বিস্তৃতি হচ্ছে, তাতে এই হ্যাশট্যাগের ব্যবহার হয়তো ততদিন পর্যন্ত কমবে না যতদিন পর্যন্ত ‘নো ব্রা’ বা বক্ষবন্ধনী ব্যবহার না করার ব্যাপারটি স্বাভাবিক একটি ঘটনায় পরিণত হবে। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/এমকেএইচ