খেলাধুলা

শুভ জন্মদিন বাংলাদেশের ‘আপন’ কিংবদন্তী

ততদিনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের এক যুগ পেরিয়েছে বাংলাদেশ দলের। খেলে ফেলেছে ২৩টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জিতে পাওয়া হয়েছে বিশ্বকাপ খেলার টিকিটও; কিন্তু পাওয়া হয়নি নিজেদের ইতিহাসের প্রথম জয়ের স্বাদ।

Advertisement

এমতাবস্থায় ১৯৯৮ সালে কেনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ দল গেল ভারতে। তারিখ ১৭ই মে, ভেন্যু হায়দরাবাদের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়াম। দিন তিনেক আগে স্বাগতিকদের বিপক্ষে পরাজয় মিলল ৫ উইকেটের ব্যবধানে। আর অল্প কিছু রান হলে সেদিনই হয়তো পাওয়া যেতো প্রথম জয়।

তাই প্রথম জয়ের অপেক্ষা গিয়ে ঠেকল সিরিজে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে, যেখানে প্রতিপক্ষ তখনকার বিবেচনায় ‘শক্তিশালী’ কেনিয়া। কেননা তখনও পর্যন্ত তাদের বিপক্ষে দু’টি ম্যাচের দু’টিতেই বড় ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ, যথাক্রমে ১৫০ রান ও ৮ উইকেটে।

যাওয়া যাক মূল ঘটনায়। দিনটি ছিল রোববার, ভারতের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। মাঠে নামল বাংলাদেশ-কেনিয়া। টসে জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন কেনিয়ার অধিনায়ক আসিফ করিম। তাদের প্রেরণা হিসেবে ছিল দুই দলের সর্বশেষ দেখায় দ্বীপক চুড়াসামা ও কেনেডি ওটিয়েনোর সেঞ্চুরিতে ভর করে করা ৩৪৭ রানের বিশাল সংগ্রহ। যা তাড়া করতে নেমে ১৯৭ রানেই থেমে যায় বাংলাদেশের ইনিংস।

Advertisement

তবে ১৭ই মে’র দিনটা ছিল অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন। তাই এদিনও বড় ইনিংসের ভিত গড়ে শুরু করা চুড়াসামা কাটা পড়েন রানআউটে, ওটিয়েনো থেমে যান দুই অঙ্কে পৌঁছার আগেই। দানব হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিলেও স্টিভ টিকোলো ফিরে যান খালেদ মাহমুদের ওভারে সরাসরি বোল্ড হয়ে। টিকতে পারেননি মরিস ওদুম্বেও।

শুরুর চার ব্যাটসম্যানকে অল্পতে থামানো গেলেও, হিতেশ মোদির ৪০ ও অভিষিক্ত রবি শাহ’র ৫২ রানের ইনিংসে ১ ওভার বাকি থাকতে ২৩৬ রানে অলআউট হয় কেনিয়া। বাঁ-হাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক নেন ৩টি উইকেট।

এক ওভার আগে অলআউট হলেও নির্ভার থাকার অনেক কারণ ছিল কেনিয়ার। কেননা ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ দল ২৩৬ এর বেশি করতে পেরেছিল মাত্র একবার। সেটি ছিল ১৯৯৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩০৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২৫৭ রানে অলআউট হওয়ার ম্যাচ।

যে কারণে ২৩৭ রানের লক্ষ্য বাংলাদেশ দলের জন্য তখন মোটামুটি পাহাড়সম ছিল; কিন্তু কেনিয়ান অধিনায়কের ঘুম হারাম করে দিতে বাংলাদেশের অধিনায়ক আকরাম খান খেলেন নিজের টেক্কার চাল। ইনিংসের সূচনা করতে পাঠিয়ে দেন লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে অধিক পরিচিত মোহাম্মদ রফিককে।

Advertisement

১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ১৫ বলে ২৬ রানের ইনিংসসহ বেশ কিছু ম্যাচে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ের জন্য বেশ নামডাক তখন রফিকের। তাই ২৩৭ রানের লক্ষ্য পেয়ে আকরাম পাঠিয়ে দিলেন তাকেই। সঙ্গে ছিলেন নিয়মিত ওপেনার আতাহার আলি খান।

বর্তমান সময়ে ধারাভাষ্য কক্ষে মাইক হাতে লিড দিলেও সেদিন ব্যাট হাতে রফিকের সঙ্গে আতাহার ছিলেন কেবল সহযোগীর রূপে। অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিয়ে রফিকও খেলতে থাকেন নিজের পছন্দমতো মারকাটারি ইনিংস।

উদ্বোধনী জুটিতে নিমিষেই পেরিয়ে যায় দলীয় পঞ্চাশ, উপভোগ্য ব্যাটিংয়ে আতাহার-রফিক করে ফেলেন ১০০ রানের জুটিও। ২৬তম ওভারের শেষ বলে সাজঘরে ফেরেন রফিক। ততক্ষণে স্কোরবোর্ডে যোগ হয়ে গেছে ওভারপ্রতি প্রায় সাড়ে পাঁচ গড়ে ১৩৭ রান।

১১৮ মিনিটের নান্দনিক ইনিংসে বাঁ-হাতি স্পিনিং অলরাউন্ডার থেকে ওপেনিং ব্যাটসম্যান বনে যাওয়া রফিক করেন ৭৭ রান। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকদের মাতিয়ে ১১ বার বাউন্ডারি ছাড়া করেন গড়িয়ে, ১ বার সরাসরি পার করেন সীমানা।

বল হাতে তিন উইকেট নেয়ার পর, ব্যাট হাতে রফিকের ক্যারিয়ার সেরা এই ইনিংসেই ঠিক হয়ে যায় ম্যাচের গতিপথ। যা অনুসরণ করে ম্যাচের ইতি টানেন আকরাম খান (৩৯) ও আমিনুল ইসলাম বুলবুল (২০*)। বাংলাদেশ পায় নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে জয়। ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন মোহাম্মদ রফিক।

প্রথম ওয়ানডে জয়ের ম্যাচে ছিলেন না হাবিবুল বাশার সুমন; কিন্তু প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়ের দিনও তিনি অনুসরণ করেন সেদিনের আকরাম খানের খেলা টেক্কার চাল। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি ছিল সিরিজ নির্ধারণী।

প্রথম দুই ম্যাচে হেরে সিরিজ খোয়াতে বসা বাংলাদেশ দলকে সিরিজ জয়ের পথে আনেন প্রয়াত অলরাউন্ডার মানজারুল ইসলাম রানা। শেষ ম্যাচে তার সেই দায়িত্ব পালন করেন হুট করেই স্পিনিং অলরাউন্ডার থেকে ওপেনিং ব্যাটসম্যান বনে যাওয়া মোহাম্মদ রফিক।

ম্যাচে টসে জিতে আগে ব্যাট করে জিম্বাবুয়ে। রানা ১০ ওভারে খরচ করেন মাত্র ২১ রান, নেন ১টি উইকেট। রফিকের ১০ ওভারে ৩৪ রানের বিনিময়ে আসে ২টি উইকেট। জিম্বাবুইয়ানরা থামে ১৯৮ রানে।

আগের দুই ম্যাচ জেতা বাংলাদেশের জন্য ১৯৯ রানের লক্ষ্যটা খুব বড় ছিল না। তবু কি মনে করে আকরামের চাল অনুসরণ করেই রফিককে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে দেন সেদিনের অধিনায়ক সুমন।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিটাও ঠিক একইভাবে করেন রফিক। নিয়মিত ওপেনার নাফিস ইকবাল তৃতীয় ওভারে ফিরে যাওয়ার পরে আফতাব আহমেদকে নিয়ে দ্বিতীয় উইকেটে যোগ করেন ১৫০ রান।

তবে এদিন শুধু রফিকের সঙ্গী নয়, বন্ধু হিসেবে একত্রে মারকাটারি ব্যাটিং করেন আফতাবও। যার ফলে দ্বিতীয় উইকেট জুটির ১৫০ রান করতে খরচ হয় মাত্র ১৩০ বল। দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সাজঘরে ফেরেন রফিক।

নামের পাশে ততক্ষণে লেখা হয়েছে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭২ রান। ২৪.৩ ওভারেই বাংলাদেশের সংগ্রহ গিয়ে পৌঁছায় ১৬১ রানে। জয় তখন দৃষ্টিসীমায়। বাকি কাজটুকু সারেন আফতাব (৮১*) ও অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন (৩৪*)।

১৭ ওভার হাতে রেখে বাংলাদেশ ম্যাচটি জেতে ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে। প্রথম ওয়ানডে জয়ের মতো প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়ের ম্যাচেও ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন মোহাম্মদ রফিক। এমন গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ইনিংস খেলা রফিক, নিজের পুরো ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১২৫ ম্যাচের ১০৬টিতে ব্যাট করে করেন ১১৯১ রান।

রফিকের প্রথম হওয়ার তালিকা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম ১০০ উইকেট, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ১০০ উইকেট, ওয়ানডে ক্রিকেট প্রথম ১০০ উইকেট প্লাস ১০০০ রান, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ১০০ উইকেট প্লাস ১০০০ রানের মাইলফলক গড়া ক্রিকেটারের নামটিও রফিক।

বাংলাদেশের মতো ছোট ও উদীয়মান ক্রিকেট জাতির পক্ষে রফিকের পরিসংখ্যান ছিল ঈর্ষণীয়। যার সাক্ষ্য দেয় তার সব রেকর্ড।

ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের দু’টি ফিফটিই ওপেনিংয়ে নেমে করা রফিক, টেস্ট ক্রিকেটে নিজের একমাত্র সেঞ্চুরিটি করেছিলেন ৯ নম্বরে নেমে। তাও কিনা আজ থেকে ১৪ বছর আগে, ২০০৪ সালে। ক্যারিবীয়দের ঘরের মাঠে, ফিদেল এডওয়ার্ডস, জার্মেইন লসন, পেড্রো কলিনস, টিনো বেস্টদের বোলিং সামলে। সেই সেঞ্চুরির সঙ্গে টেস্ট ক্যারিয়ারে ৪টি ফিফটি রয়েছে রফিকের। ৩৩ ম্যাচের ক্যারিয়ারে তার মোট রান ১০৫৯।

সে সময় বাংলাদেশের ম্যাচে ব্যাটিংয়ের মূল বিজ্ঞাপন যদি হতো আফতাব, জাভেদ ওমর বা সুমনের ৪০-৫০ রানের লড়াকু ইনিংগুলো, বোলিংয়ে এই বিজ্ঞাপনের দায়িত্বটা পালন করতেন স্পিন জাদুকর মোহাম্মদ রফিক।

৩৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে খুব কম ম্যাচেই পেরেছিলেন দুইবার বল করতে। নাহয় উইকেট সংখ্যা হতে পারতো আরও বেশি। তবু ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে ৪ উইকেট নিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ১০০ উইকেটের রেকর্ড গড়েই থামেন এই স্পিন মায়েস্ত্র। পুরো ক্যারিয়ারে ইনিংসে ৫ উইকেট নেন ৭ বার। যা কি-না সাকিব আল হাসানের পর এখনও বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ওয়ানডে ক্রিকেটে ১২৫ ম্যাচে রফিকের উইকেট সংখ্যাও ১২৫টিই।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম কিংবদন্তী মোহাম্মদ রফিকের ৪৯তম জন্মদিন আজ (৫ই সেপ্টেম্বর)। স্বাধীনতার আগের বছর ঢাকার অদূরেই মাদারীপুরে জন্ম নেয়া রফিক ১৯৯৫ থেকে ১৩টি বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের।

আরও অনেক সাবেক ক্রিকেটারের মতোই মোহাম্মদ রফিকের প্রতিও কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ ক্রিকেট। দেশের ক্রিকেটে তাদের অবদান কখনোই ভোলার নয়। জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও দোয়া বাংলাদেশের আপন কিংবদন্তীর জন্য।

এসএএস/আইএইচএস/জেআইএম