মারাত্মক অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। অধিকাংশ গোডাউন ও ওপেন ইয়ার্ডে নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জাম থাকলেও তা অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকায় আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে পণ্যগার। বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে আমদানিকৃত অতি দাহ্য পণ্যের সঙ্গে সাধারণ পণ্যও রাখা হচ্ছে। এতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন বেনাপোল স্থলবন্দরে ইতোপূর্বে অন্তত আটবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট বন্দরের ৩৫ নম্বর শেডে আগুন লেগে কোটি টাকার আমদানিকৃত পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০ বছরে বেনাপোল বন্দরের গোডাউনে ৮ বার আগুন লেগেছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় প্রতিবারই আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। ডাকতে হয়েছে দমকল বাহিনীকে। এ কারণে পুড়ে গেছে আমদানিকৃত কোটি কোটি টাকার পণ্য। কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি তারা। আগুন নিয়ন্ত্রণে বন্দরে যেসব সরঞ্জাম আছে সেগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোলে ৩৮টি গোডাউন ও ওপেন ইয়ার্ড আছে। তাতে ধারণ ক্ষমতা ৪৭ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন পণ্য। কিন্তু রাখা হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন পণ্য। গাদাগাদি করে পণ্য রাখায় অগ্নি ঝুঁকি আরও প্রকট হয়েছে।
Advertisement
সম্প্রতি বন্দরের ৩২ নম্বর গোডাউনে গিয়ে দেখা গেছে, ৪০০ মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতার এ গুদামে অতি দাহ্য ও সাধারণ পণ্য একই জায়গায় পাশাপাশি রাখা হয়েছে। ড্রাম ভর্তি ডাইস (রঙ), বস্তা ভরা রেইজিং পাউডার, ছাপাখানার কালিসহ অন্যান্য পণ্য রাখা আছে। গোডাউনের এক কোনায় পণ্যের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে সহজে বহনযোগ্য অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র (এক্সটিংগুইসার)। যার সবগুলোই অকেজো।
আগুন নেভানোর যন্ত্রগুলো এভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কেন?-জানতে চাইলে গোডাউন ইনচার্জ ফারুকুজ্জামান বলেন, ‘ওইগুলো দেখভাল করার জন্য বন্দরের আলাদা কর্মী রয়েছে। তারা ওইসব দেখে। আমি শুধু বলতে পারি, ২০ কেজি ওজনের ১০টি যন্ত্র রয়েছে। তবে, সেগুলো চালু আছে কিনা তা আমি জানি না।’
পাশের ৩৪ নম্বর গোডাউনে গিয়ে দেখা যায়, গাড়ির ইঞ্জিন অয়েল (লুব্রিকেন্ট), রাসায়নিক, ডাইস ও ছাপাখানার কালিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রয়েছে। এখানেও পণ্য রাখার কোনো শৃঙ্খলা নেই। আগুন নেভানোর যন্ত্রগুলোও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায়, বহুকাল যন্ত্রগুলোতে হাত পড়েনি। ২৯ নম্বর গোডাউন ও খালি ট্রাক টার্মিনালে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। আগুন নেভানোর নিজস্ব ভালো কোনো ব্যবস্থাপনা নেই।
ব্যবহারকারীরা জানান, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর বন্দরের ২৩ নম্বর গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে সেখানে রাখা তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পের আমদানিকৃত কাপড়, ডাইস (রঙ), বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক, শিল্পের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, মোটর গাড়ির যন্ত্রাংশ, ফাইবার, মশা তাড়ানো স্প্রে, তুলা, কাগজসহ বিভিন্ন ধরণের পণ্য পুড়ে যায়। যার দাম কয়েক কোটি টাকা। তখন তদন্ত কমিটি করা হলেও তিন বছরেও ব্যবসায়ীরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।
Advertisement
এ ব্যাপারে আমদানি-রফতানিকারক সমিতি, বেনাপোলের সহ-সভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘বন্দরের প্রতিটা গোডাউন ও ওপেন ইয়ার্ড অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। বন্দরের পরিচালক ও কর্তৃপক্ষকে বহুবার বলেছি, কিন্তু তারা কর্র্ণপাত করেননি। গত ১০ বছরে বন্দরে অন্তত ৮ বার আগুন লেগেছে। এতে শত শত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। বন্দরে কোনো তদারকি নেই।
এদিকে প্রায়ই বন্দরের গোডাউন থেকে পণ্য চুরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। চুরি ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি নেই। চুরির প্রমাণ ঢাকতে অনেক সময় পরিকল্পিতভাবে আগুন দেয়া হয়। আজও এ বন্দর সিসি টিভি ক্যামেরার আওতায় আসেনি। যে কারণে এসব ঘটনা ঘটেই চলেছে। সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট ৩৫ নম্বর শেডে আগুন লাগায় ব্যবসায়ীরা কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হন।
বেনাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়াডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘বন্দরে পণ্য রাখার জায়গা নেই। গোডাউনে অতি দাহ্য পণ্যের সঙ্গে সাধারণ পণ্যও রাখা হচ্ছে। এতে সেখানে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাচ্ছে। বন্দরে পণ্য রাখার জায়গা বাড়াতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলেই কেবল এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও আমদানিকারক মিজানুর রহমান খান জানান, বেনাপোল বন্দরের শেডে এর আগে কয়েকবার আগুন লাগায় ব্যবসায়ীরা সর্বশান্ত হয়েছেন। আমরা বারবার বলার পরও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ব্যবসায়ীরা সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছে, বন্দরের ভাড়া দিচ্ছে, অথচ তাদের আমদানিকৃত পণ্যের নিরাপত্তা দিচ্ছে না। রহস্যজনক কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব পণ্যের বীমাও করেন না।
এ ব্যাপারে বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক প্রদোষ কান্তি দাস বলেন, এখন গরমের সময়। তাই যে কোনো সময় আগুন লাগার মত মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য আমরা সতর্ক আছি। প্রতিটা গোডাউনে ফায়ার হাইডেন পয়েন্ট ও ফায়ার পাম্প রয়েছে। যেসব গোডাউনে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ রয়েছে সেগুলো দ্রুতই ত্রুটিমুক্ত করা হবে।
মো. জামাল হোসেন/এমএমজেড/জেআইএম