ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছোট ছেলে হত্যার বিচারের আশায় বড় ছেলেকে নিয়ে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এক বৃদ্ধ বাবা। পুলিশের এ দরজা থেকে ও দরজা ঘুরে শুধুই আর্তনাদ করছেন তিনি। কিন্তু তার সেই আর্তনাদে মন গলছে না পুলিশের। রহস্যজনক কারণে হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই মাসেও কোনো আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো হত্যা মামলাটি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) অথবা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে স্থানান্তরের আবেদন করার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা বাদীকে ‘চাপ দিচ্ছেন’ বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা।
Advertisement
গত ৯ জুলাই রাতে আশুগঞ্জের লালপুর গ্রামে খুন হন কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের টোকচাঁনপুর গ্রামের তাহের মিয়ার ছেলে আমজাদ হোসেন (৩০)। পুলিশ জানিয়েছে গরুচোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন আমজাদ।
তবে আমজাদের পরিবারের দাবি, লালপুর গ্রামের আশরাব আলীর ছেলে জহির মিয়া ও তার লোকজন পরিকল্পিতভাবে আমজাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। অবশ্য হত্যাকাণ্ডের দুই মাস হতে চললেও এখনও পর্যন্ত আমজাদের বিরুদ্ধে গরু চুরি কিংবা চুরির ঘটনায় সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ যোগাতে পারেনি আশুগঞ্জ থানা পুলিশ। এর ফলে প্রকৃতপক্ষে আমজাদ গরু চোর কি না বা গরু চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না সেটি নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।
আমজাদ হত্যা মামলাটি তদন্ত করছেন আশুগঞ্জ থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) ময়নাল হোসেন। গণপিটুনির ঘটনায় জহির মিয়ার ভাই মোক্তার মিয়ার দায়ের করা মামলাটিও তিনিই তদন্ত করছেন। দুই পক্ষের মামলার তদন্তভার একই কর্মকর্তা পাওয়ায় সুষ্ঠু তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আমজাদ হত্যা মামলার তদন্ত কাজে পুলিশ গাফিলতি করছে বলেও অভিযোগ করেছেন তার স্বজনরা।
Advertisement
নিহত আমজাদ হোসেনের বাবা তাহের মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছেলে কখনোই গরু চুরি করেনি। এ ধরনের কোনো ঘটনা আমরা শুনিনি। থানায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে গেলে তিনি বলেন ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দেবেন। আর না হলে আপনারা ৪ জন সাক্ষী যোগাড় করে দেন। এসপি-এডিশনাল এসপির সঙ্গে দেখা করেও কোনো কিছু হচ্ছে না। আমি চাই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আমার ছেলে হত্যার বিচার হোক। তদন্তে যদি আমার ছেলে চোর প্রমাণিত হয় তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
আমজাদের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে জানান, আমজাদ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নন্দনপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। শুষ্ক মৌসুমে টোকচাঁনপুর গ্রামে পরিবারে সঙ্গে কৃষি কাজ আর বর্ষা মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালাতেন আমজাদ। গত ৯ জুলাই কোরবানির জন্য গরু কিনতে এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বাইশমৌজা বাজারে আসেন আমজাদ। বাজারেই জহিরের সঙ্গে দেখা হয় তার। জহির তার বাড়িতে গরু আছে জানিয়ে আমজাদকে গরু দেখে আসার জন্য বলেন। এক প্রকার জোর করেই আমজাদকে নৌকায় করে লালপুর গ্রামে তার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হন জহির। কিছুদূর যাওয়ার পরই জহির ও তার সহযোগীরা আমজাদকে মারধর করে তার সঙ্গে থাকা গরু কেনার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ সময় আমজাদ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে তাকে লালপুর গ্রামে প্রয়াত গোলাপ মেম্বারের বাড়িতে আটকে রেখে পিটিয়ে জোরপূর্বক তার কাছ থেকে গরু চুরি করতে আসার স্বীকারোক্তি আদায়ের ভিডিওচিত্র ধারণ করে। তাকে মেরে ফেলার পর মরদেহ গুম করার চেষ্টা করে। কিন্তু গুম করতে না পারায় গরু চোর সাজিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে তারা।
তিনি জানান, অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ঘটনার দিন মধ্যরাতে আমার বড় বোনকে ফোন করে জানায় আমজাদকে গোলাপ মেম্বারের বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। পরদিন (১০ জুলাই) সকালে গোলাপ মেম্বারের বাড়িতে রওনা হওয়ার পর অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির নম্বরে ফোন করলে তিনি জানান গোলাপ মেম্বারের বাড়িতে না গিয়ে আশুগঞ্জ থানায় খবর নেয়ার জন্য। পরে থানায় গিয়ে ডিউটি অফিসারকে জিজ্ঞেস করি আমজাদ নামে কাউকে আনা হয়েছে কি না। ডিউটি অফিসার বলেন এ নামে কেউ নেই।
আবার অজ্ঞাত ওই ব্যক্তিকে ফোন করলে তিনি লালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন আমার ভাই খারাপ, আমরা থানায় অথবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে গিয়ে যেন খোঁজ নিই। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ভাইয়ের মরদেহ।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ময়নাতদন্তের পর আমরা মরদেহ নিয়ে আশুগঞ্জ থানায় আসি মামলা করার জন্য। থানার ওসি বলেন আগে মরদেহ দাফন করে এসে তারপর মামলা করার জন্য। পরে মরদেহ নিয়ে বাড়িতে পৌঁছার পর ওইদিন সন্ধ্যায় ওসি আমার বাবাকে ফোন করে দ্রুত থানায় এসে মামলা করার জন্য বলেন। এরপর ১২ জুলাই থানায় গেলে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশের লেখা মামলার এজাহারে আমার বাবার স্বাক্ষর নেয়া হয়। আমরা জহির এবং মোক্তার জড়িত বললে ওসি বলেন নাম লাগবে না, তদন্তে নাম বের হবে। পরবর্তীতে জানতে পারলাম তারাও (জহির-মোক্তার) মামলা করেছে।
থানায় গেলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন এখনও মামলায় হাত দেননি, তার হাত বাঁধা। আপনারা মামলা ডিবি অথবা পিবিআইতে নিয়ে যান। পরে ওসির সঙ্গে কথা বলে পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেনের কাছে পাঠান। তার কাছে গেলে তিনি বলেন এখন ঈদের চাপ, ঈদের পরে আমরা অ্যাকশন নেব। ঈদের পরে গেলে তিনি বলেন আপনার ভাই গরু চোর। গরু চোর হলে প্রমাণ দিক যে সে গরু চুরি করতে গেছে। বাবাকে নিয়ে দুই-তিনবার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছে গিয়ে কাজ না হওয়ায় আবার পুলিশ সুপারের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
লালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের জাগো নিউজকে বলেন, জহিরের সঙ্গে আমজাদের কোনো বিরোধ ছিল কি না আমি জানি না। সকালে গণপিটুনির খবর পেয়ে আমি গোলাপ মেম্বারের বাড়িতে গিয়ে আমজাদকে সিএনজি অটোরিকশায় করে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। হাসপাতালে নেয়ার পর সে মারা যায়।
ভৈরবের আগানগর ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য তায়েব আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমজাদকে ভালো ছেলে বলেই জানি। তার বিরুদ্ধে গরু চুরি কিংবা কোনো খারাপ কাজ করার কথা শুনিনি।
তবে জহির মিয়া তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ৯ জুলাই দিবাগত রাত ১টার দিকে আমজাদসহ কয়েকজন চোর তার বাড়িতে গরু চুরি করতে গিয়েছিলেন। গোয়াল থেকে গরু নিয়ে বের হওয়ার সময় তিনি আমজাদ ও হেলাল নামে আরেক চোরকে ধরে ফেলেন। এ সময় তারা ধারালো ছুরি দিয়ে জহিরকে আঘাত করতে থাকেন। এক পর্যায়ে হেলাল পালিয়ে গেলেও জহিরের চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এসে আমজাদকে ধরে গণপিটুনি দেয়। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। আমজাদের সঙ্গে তার পরিচয় নেই এবং কোনো পূর্ব বিরোধ ছিল না বলেও জানান জহির।
এ বিষয়ে আশুগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসুদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, মামলার এজহার লিখে এবং পড়েই স্বাক্ষর করেছেন। কারো নাম জানে না বিধায় অজ্ঞাতনামা দিয়েই এজহার দায়ের করেন। আমজাদের বিরুদ্ধে গরু চুরির কোনো প্রমাণ পেয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন তদন্ত অব্যাহত আছে।
তদন্তে পুলিশের গাফিলতির অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. আলমগীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, যতটুকু জানতে পেরেছি গরু চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন আমজাদ। জহিরের সঙ্গে পূর্ববিরোধ নিয়ে আমজাদের পরিবারের বক্তব্যের আলোকেও তদন্ত করে দেখছি আমরা। পুলিশের তদন্ত তো আর শেষ হয়ে যায়নি, তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে ফলাফল লিখিতভাবে বাদীকে জানানো হয়। একই ঘটনায় দুইটি মামলা হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী একই কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানো হয় বলেও জানান তিনি।
এফএ/এমকেএইচ