প্রবাস

মালয়েশিয়ায় শ্রমশক্তির প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশিরা

বিদেশে প্রায় ১০ মিলিয়ন বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভারত, মেক্সিকো, রাশিয়া ও চীনে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে অভিবাসী শ্রমিক পাঠাচ্ছে সেসব দেশে কাজ করতে। এসব দেশের শ্রমশক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীদের। বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীরা সাধারণত মালি, নির্মাণশ্রমিক, কৃষি, পরিচ্ছন্নকর্মী হিসাবে নিযুক্ত। গত বছর অভিবাসী কর্মীদের মাধ্যমে ১৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠানো হয়, যাকে অর্থনীতির ভাষায় রেমিট্যান্স বলা হয়। টেক্সটাইল শিল্পের পর এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস।

Advertisement

শ্রমিক, অ্যাকটিভিস্ট ও মানবাধিকার সংগঠনের মতে, বিদেশে তাদের মাস বা বছরগুলো ঘৃণা, শোষণ ও অপব্যবহারের গল্পের। বিদেশে যেতে আগ্রহী শ্রমিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পাদনে একটি বিশাল চক্র ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বিকশিত হয়েছে।

অভিবাসন নিয়ে কাজ করছেন এমন সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ব ব্যাংকের মতে মাইগ্রেশন এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের একটি। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিবাসীর মজুরি তার পরিবারের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য সরবরাহ করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশিরা কখনো কখনো পাঁচ, দশ এমনকি ২০ বছর ধরে বিদেশে কাজ করেন শুধু একটু ভালোভাবে জীবনযাপনের চেষ্টায়।

কর্মকর্তারা বলছেন, রেমিট্যান্সের সুবিধাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পোশাক শিল্প থেকে রপ্তানি করে দেশে আনা অর্থের বিপরীতে এই অর্থ সারা বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবুও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্রতম দেশ। সাম্প্রতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও মাথাপিছু আয় বছরে দুই হাজার ডলারের কম। কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি শ্রমিকদের জন্য অনেক বিপদ। ভিসা, ফ্লাইট ও ওয়ার্ক পারমিটের জন্য দালালেরা তাদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে। এক কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের দ্বারা ভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। এভাবেই দেশে ও দেশের বাইরে নানা সমস্যার শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। চাকরিচ্যুতি, গ্রেপ্তার আতঙ্ক, প্রতারণা, কাঙ্খিত কাজ না পাওয়ায় স্বপ্নের প্রবাস অনেকের কাছে হয়ে উঠছে দুর্বিষহ।

Advertisement

এ ছাড়া কাজের চাহিদা না থাকলেও কিছু দালাল চক্র নানা ফন্দি-ফিকির করে সেসব দেশে বাংলাদেশি কর্মী পাঠিয়ে ভোগান্তিতে ফেলছে তাদের। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য বিশফোড়া রোহিঙ্গা : একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে একজন শ্রমিককে আনতে গেলে দীর্ঘদিন অপেক্ষা আর জটিলতার কারণে রোহিঙ্গাদের দিকে ঝুঁকছে সে দেশের ব্যবসায়ীরা।

একজন বৈধ শ্রমিককে মালয়েশিযার আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে বেতন দিতে হয়। যদি কোম্পানিতে কাজ নাও থাকে, তাহলেও মালাই রিংগিত ১,১০০ অর্থাৎ বাংলাদেশি ২২ হাজার টাকা সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করেছে সরকার। মালয়েশিযার বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের চাহিদা কম থাকায় দিন দিন কমে যাচ্ছে ওভারটাইমসহ নিম্নতম ৮ ঘণ্টা কাজ।

বৈধ শ্রমিকদের জন্য বছরে ভিসা, বাসস্থান, ইলেকট্রিক, পানির বিলসহ একজন শ্রমিকের পিছনে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়। খরচ বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের দিকেই ঝুঁকছে অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা। একজন রোহিঙ্গাকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দিলেই কাজে লেগে যায়। নেই কোন বাড়তি খরচ।

ইউএনএইচসিআর থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী বসবাসের জন্য একটি কার্ড ইস্যু করা হয়। শুধু মালয়েশিয়া নয়, সারা বিশ্বেই রোহিঙ্গাদের জন্য এই প্রথাটি চালু আছে। আর এই কার্ড এর উপর ভিত্তি করেই মালয়েশিযা জুড়ে তারা কাজ করে যাচ্ছে। প্রয়োজন হয় না কোন ভিসা এবং যেকোনো কাজ করতে নেই কোন বাধা। যেখানে বৈধ একজন শ্রমিকের জন্য নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে সে কোথায় কাজ করতে পারবে। তার বাইরে কাজ করলে তাকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়। গ্রেফতার হয়ে যেতে হয় জেলে। বৈধ শ্রমিকের জন্য যেখানে বছরে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়। সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য এক টাকাও খরচ হয়না। বরং বেতন আরো কম দিয়ে দিব্বি চলছে তাদের কাজকর্ম।

Advertisement

আগের দিনে রোহিঙ্গাদের দেখা কম মিললেও বর্তমানে মালয়েশিয়াজুড়ে রোহিঙ্গাদের দেখা মেলে। ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে রোহিঙ্গা। আর বাংলাদেশিদের সঙ্গে চেহারার মিল থাকায় অনেকেই বাংলাদেশি পরিচয়ে সুবিধা লুটে নিচ্ছে। অনেকেই অবৈধ এবং সমাজ বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ধরা পড়লেই বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গারা।

যে কারণে মালয়েশিয়ানরা ভাবে বাংলাদেশিরা অনেক খারাপ। বাংলাদেশিদের ব্যাপারে অধিকাংশ মালয়েশিয়াানদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গারা।

মালয়েশিয়ায় চুরি-ছিনতাইসহ সমাজ বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে অনেক রোহিঙ্গা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়া থেকে হুন্ডির মাধ্যমে সব থেকে বেশি টাকা যায় চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজারে। মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন রোহিঙ্গাদের দোকান থেকে হুন্ডির ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে।

এ ব্যাপারে কথা হয় সেদেশে থাকা একাধিক বাংলাদেশিদের সঙ্গে। হোটেলে কর্মরত আব্দুল ওহাব এ প্রতিবেদককে জানান, বিগত দিনে আমাদের মালিকরা আমাদের অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু বর্তমানে রোহিঙ্গারা সামান্য কিছু বেতনে চাকরি করছে আর যে কারণেই দিন দিন আমাদের কদর কমে যাচ্ছে।

গত মাসে মালিক বলেছে, এখন কাজের সিজন ভালো না, তাই যদি দেশে চলে যেতে চাও, যেতে পারো, কারণ বেশি বেতন দিয়ে আমি আর ব্যবসা চালাতে পারবো না। যাই টুকটাক কাজ চলছে তা আমি রোহিঙ্গাদের দিয়ে করিয়ে নিতে পারবো, তাতে আমার সামান্য কিছু খরচ হবে।

এমনই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বহু বাংলাদেশিদের। মালিক পক্ষ টাকা বাচানোর জন্য ব্যবসা ভালো নয় বলে জানিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের দিয়ে কাজকর্ম পরিচালনা করছে। বৈধ শ্রমিকের জন্য প্রতিবছর নির্দিষ্ট হারে একটি খরচ হয়ে থাকে। তাই বাড়তি আর টাকা খরচ না করে রোহিঙ্গাদের দিকে ঝুঁকছে মালিকরা।

আবার অনেক মালিক আছে যারা বাংলাদেশিকে পাসপোর্ট দিয়ে অন্যত্র কাজ করতে বলছে এবং লম্বা ছুটিতে দেশে যাওয়ার কথা জানিয়ে দিচ্ছে।

এমআরএম