জাতীয়

জাহালম হতে হতে বেঁচে গেলেন কামাল

সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২৬ মামলার ‘ভুল’ আসামি পাটকল শ্রমিক জাহালম প্রায় তিন বছর বিনা অপরাধে কারাভোগ করেন। অতঃপর বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে এলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এবার খোদ রাজধানীতে জাহালমের মতো বিনা অপরাধে পুলিশি নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছিলেন কামাল হোসেন নামে এক মোটরসাইকেল মেকানিক।

Advertisement

চার্জশিটভুক্ত এক আসামির সঙ্গে শুধু নাম ও বাবার নাম মিল থাকায় মেকানিক কামাল হোসেনকে থানায় আটকে রেখে হয়রানি করেন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। মামলা থেকে রেহাই পেতে পুলিশকে ‘খুশি’ও করতে বলা হয়। তবে ভুল আসামি ধরার সত্যতা পাওয়ায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নির্দেশে নিরীহ মোটর মেকানিক কামাল হোসেনকে ছেড়ে দেয়া হয়। ওই ঘটনায় জড়িত দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে পরবর্তীতে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। অল্পের জন্য নতুন করে জাহালম কাণ্ড থেকে বেঁচে যান কামাল হোসেন।

ঘটনাটি ৩০ আগস্ট (শুক্রবার) বিকেলের। মোহাম্মদপুর থানার আওতাভুক্ত শ্যামলী রিং রোডের বাদশাহ ফয়সাল ইনস্টিটিউট সংলগ্ন গলিতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ সময় দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদপুর থানার এএসআই জাকারিয়া মাদক মামলার আসামি উল্লেখ করে মোটরসাইকেল মেকানিক কামাল হোসেনকে আটক করেন।

শ্যামলীর রিং রোডে কামাল হোসেনের নিজের একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজ রয়েছে। এলাকায় মোটর মেকানিক হিসেবেই পরিচিত তিনি। বারবার নির্দোষ দাবি করলেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কামাল হোসেনকে থানায় আটকে রাখা হয়।

Advertisement

মোহাম্মদপুর থানা সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের একটি মাদক মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামির নাম মো. কামাল। বাবার নাম মনির। নিরীহ কামাল হোসেনের বাবার নামও মনির হোসেন।

কামালকে থানায় নেয়ার পর পুলিশ যাচাই করে দেখে আসামি কামালের জন্ম ১৯৮২ সালে। আটক কামাল হোসেনের জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৬ নভেম্বর। আসামি কামালের মায়ের নাম, জন্মসাল, এলাকা ও পেশার সঙ্গে আটক কামাল হোসেনের মায়ের নাম, জন্মসাল, এলাকা ও পেশার মিল নেই।

শুধু তা-ই নয়, নিরীহ কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানাসহ ডিএমপির কোনো থানায় কোনো মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরিরও (জিডি) তথ্য পায়নি পুলিশ। শুধু আসামির সঙ্গে নাম ও বাবার নামের মিল থাকায় তাকে আটক করে থানায় নেয়া হয়। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই শেষে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নির্দেশে শুক্রবার রাতেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

থানা থেকে ছাড়া পেলেও একদিন পর রোববার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে মেকানিক কামাল হোসেনের গ্যারেজে হাজির হন অভিযানে অংশ নেয়া মোহাম্মদপুর থানার আরেক এএসআই আলমগীর।

Advertisement

এ বিষয়ে মেকানিক কামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাকে শুক্রবার এএসআই জাকারিয়া থানায় নিয়ে যান। রোববার জাকারিয়ার বন্ধু পরিচয়ে মোহাম্মদপুর থানার আরেক এএসআই আলমগীর আমার কাছে আসেন। তিনি বলেন, মামলা খারিজ পেতে বা মামলা থেকে আমার নাম বাদ দিতে চাইলে পুলিশকে খুশি করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাকে ঝামেলা পোহাতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাকে বলেছি, আপনারা মূল আসামি ধরেন। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তার ও আমার এনআইডি নিয়ে মিলিয়ে দেখেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, গলদ কোথায়?’

এদিকে নিরীহ কামাল হোসেনকে আটকের ঘটনায় এলাকায় সমালোচনা শুরু হলে বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। পরে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ওয়াহেদুল ইসলামকে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেয় ডিএমপি।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আনিসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ওই দুই পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড (প্রত্যাহার) করে ডিসি কার্যালয়ে নিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আজকের (সোমবার) মধ্যেই প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

তদন্তের বিষয়ে এডিসি ওয়াহেদুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘টাকা চাওয়া বিষয়টি এখনও প্রমাণিত হয়নি। তবে নিরীহ মেকানিক কামাল হোসেনকে আটকের ক্ষেত্রে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি-না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। তদন্তের স্বার্থে দুই এএসআইকে ক্লোজড করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করে ওসি নিরীহ ব্যক্তিকে ছেড়ে দিয়েছেন। নিরীহ কোনো ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে ডিএমপি সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে।

থানা পুলিশের ঝামেলা শেষে নিরীহ কামাল বলেন, ‘আমি আরেক জাহালম হতে হতে বেঁচে গেলাম। পরিচিত সাংবাদিক ও দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের কারণে আমি বেঁচে গেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত ২-৩ দিন আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ ছিল। বুঝতে পারছিলাম না আমার অপরাধটা কী ছিল! পরিবারের সবাই ভেঙে পড়েছিল। অবশেষে ভুল বোঝাবুঝি শেষে তারা (মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ) আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।’

এআর/জেইউ/আরএস/এমএস