গাইবান্ধায় বন্যার পানি নেমে গেলেও রয়ে গেছে চিহ্ন। এক মাসেও ঠিক হয়নি লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভেঙে যাওয়া সড়কগুলো ঠিক না করায় বন্যা-পরবর্তী সময়ে বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ।
Advertisement
এরই মধ্যে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে একটি সেতুর ওপর বাঁশের সাঁকো তৈরি করে কোনোমতে যাতায়াত করছে। কিন্তু ওই সাঁকোতে ভরসা নেই তাদের। প্রতিদিন হাজারো মানুষের যাতায়াতের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সাঁকোটি।
এদিকে, বন্যায় ভেঙে যাওয়া সড়কগুলো বন্যা-পরবর্তী সময়ে মেরামতের আশ্বাস দেয়া হলেও এখনো সংস্কার করা হয়নি। ফলে বন্যার আতঙ্ক কেটে গেলেও দুর্ভোগের শেষ নেই এ অঞ্চলের মানুষের। দেখে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ।
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়ন ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সিমাম। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ভ্যানযোগে বিদ্যালয়ে যেতে পাঁচ টাকা খরচ হতো তার। কিন্তু বন্যার কারণে তার যাতায়াতের সড়ক নষ্ট হওয়ায় পাঁচ টাকার ভাড়া ১০-১৫ টাকা দিতে হয়। সংসারে অভাবের কারণে প্রতিদিন সিমামের যাতায়াতের ভাড়া দিতে পারেন না না বাবা। যেদিন টাকা দিতে পারেন সেদিন বিদ্যালয়ে যায় সিমাম। যেদিন দিতে পারেন না সেদিন সিমাম বিদ্যালয়ে যায় না।
Advertisement
সিমামের মতো একই অবস্থা ওই বিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থীর। প্রতিদিন যাতায়াতের ভাড়ার অভাবে সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারেন না অনেক বাবা-মা। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। বিদ্যালয়ে ঠিকমতো আসতে না পারায় পিছিয়ে পড়ছে তারা।
সাঘাটা উপজেলার রাগনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান আগে প্রতিদিন সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেন। কিন্তু এখন সকাল ৮টায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। এরপরও বিদ্যালয়ে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারেন না শিক্ষক আতাউর রহমান। এর মূল কারণ সড়কের বেহাল অবস্থা। বন্যা পরবর্তীতে সড়কগুলো সংস্কার করা হয়নি। পাশাপাশি সড়ক পারাপারে রয়েছে বাঁশের সাঁকো। সাঁকোগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয় তাকে। যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার আতঙ্ক তো আছেই।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তেতুলতলি বাজার এলাকার ফেরিওয়ালা মহব্বত আলী বলেন, জীবিকার তাগিদে মালামাল আনতে শহরে যেতে হয়। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় শহর থেকে মালামাল গ্রামে আনতে পারছি না। ফলে বেচাকেনা বন্ধ। ফলে চরম দুর্ভোগে কাটছে দিনরাত।
একই উপজেলার ভাতমারা গ্রামের বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম বলেন, আমার গ্রাম থেকে জেলা-উপজেলা শহরে যাওয়ার সবকটি রাস্তার কিছু অংশ বন্যায় ধসে গেছে। ফলে শহর থেকে মালামাল আনা সম্ভব হয় না। মালামাল আনতে কয়েক কিলোমিটার ঘুরে শহরে যেতে হয়। বন্যার দীর্ঘ সময় পার হলেও ভাঙা রাস্তাগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
Advertisement
এদিকে, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে ত্রিমোহনী ব্রিজ হয়ে সাঘাটা উপজেলার সঙ্গে সহজ যোগাযোগের সড়কটির ওপর নির্মিত তিনটি সেতু ভেঙে গেছে। ফলে এই তিনটি স্থানে কাঠ বা বাঁশের সাঁকো দেয়া হলেও সাঁকোগুলো দুর্বল। ফলে হেঁটে চলা ছাড়া কোনো যানবাহন চলাচল করে না।
সাঘাটা উপজেলার বাটি গ্রাম, পশ্চিম রাঘরপুর, ভূতমারা, ফুটানির বাজার, রামনগর, দলদলিয়া, ময়মন্তপুর, মানিকগঞ্জ, বুরুঙ্গী, কানিপাড়া ও গাছাবাড়িসহ ১৫টি গ্রামের কাঁচা-পাকা সড়ক ভেঙে গেছে। এসব সড়ক এখনো সংস্কার করা হয়নি।
পাশাপাশি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ, তেতুলতলি, সোনাইডাঙ্গা, তালুক সোনাইডাঙ্গা, চর সোনাইডাঙ্গা, নাকই, মধুরাপুর ও নারায়ণপুর গ্রামসহ ১০টি গ্রামের কাঁচা-পাকা সড়ক ভেঙে গেছে। এখনো এসব সড়ক সংস্কার না করায় দুর্ভোগের শেষ নেই এসব গ্রামের মানুষের।
এছাড়া সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী ইউনিয়নের পোরাগ্রাম এলাকায় গাইবান্ধা-সাঘাটা আঞ্চলিক মহাসড়ক ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় জেলার সঙ্গে বাস-ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ভরতখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামছুল আজাদ শিতল বলেন, বাঁশ, কাঠ ও ড্রাম দিয়ে সাঁকো তৈরি করে যাতায়াত করছে গ্রামবাসী। বন্যার পর আমার ইউনিয়নের কোনো সড়ক এবং সেতু সংস্কার করা হয়নি। দ্রুত এসব সড়ক ও সেতু মেরামতের অনুরোধ জানাচ্ছি।
গাইবান্ধার সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম বলেন, এবারের বন্যায় শুধু সাঘাটা উপজেলার ১১৭টি পাকা সড়কের ২৫০ কিলোমিটার মধ্যে ৫০ কিলোমিটার ভেঙে গেছে। ১০টি সেতুর সংযোগসড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক ও সেতুর তালিকা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে সংস্কার করা হবে।
গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, মানুষ যাতে কষ্ট না পায় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অক্টোবর মাসের মধ্যেই এসব সড়ক ও সেতুর সংস্কারকাজ শুরু হবে।
এএম/এমএস