বিনিয়োগ স্থবিরতা। ধারাবাহিকভাবে কমছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি। উচ্চ সুদহার যার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা। সুদহারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে। নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো বেড়েই চলছে ঋণের সুদহার।
Advertisement
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে গত জুলাই শেষে ৩১ ব্যাংকের ঋণের সুদহার দুই অঙ্কের ওপরে রয়েছে। বাকি অধিকাংশ ব্যাংকেই দুই অঙ্ক ছুঁইছুঁই। তবে একক ঋণ হিসেবে ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো ব্যাংকের সুদহার সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ আদায় করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুদহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ব্যাংক মালিকরা। অন্যদিকে নানা সুযোগ-সুবিধাও নিয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে এক বছরেও সুদহারের সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে চলমান ব্যাংকের পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে ছয়-নয় অর্থাৎ আমানত সংগ্রহের সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ এবং ঋণ বিতরণের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়নে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
ওই সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংক ব্যবসার অনুমোদন যারা দেয় তারা বাতিলও করতে পারে। সুতরাং সুদহার বাস্তবায়ন নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। এ মুহূর্তে সরকারিসহ মোট ১৬টি ব্যাংক ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন করেছে। আস্তে আস্তে সব ব্যাংকই সিঙ্গেল ডিজিটে চলে আসবে।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা না হলেও সুদহার কমাতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে গত ২০ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি সার্কুলার জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, যেসব ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে পারবে না, ওইসব ব্যাংকে সরকারি আমানত রাখা হবে না।
এছাড়া তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি চাপকে কেন্দ্র করে সুদহার বাড়তে থাকায় তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৩০ মে এক নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংকগুলো বিভিন্ন প্রকার ঋণের সুদহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করছে। ঋণের সুদহার অযৌক্তিক মাত্রায় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে ভোক্তা ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে স্প্রেড ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আগে যা ৫ শতাংশ ছিল। এত পদক্ষেপ ও হুঁশিয়ারির পরও ঋণের সুদহার কমছে না, উল্টো বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ জুলাইয়ের ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকগুলোর জুনের তুলনায় জুলাইয়ে বেসরকারি ব্যাংকের গড় ঋণের সুদহার দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ (.০৩) বেড়ে ১০ দশমিক ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের আমানতের সুদহার দশমিক ১৭ শতাংশ (.১৭) কমে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জুলাই শেষে গড় ঋণের সুদহার ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর আমানতের সুদহার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশে।
ঋণের সুদহার দুই অঙ্কে রয়েছে ৩১ ব্যাংক। তাদের মধ্যে বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ঋণের সুদহার ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ১০ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ব্যাংক আল ফালাহ ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ।
Advertisement
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটি ব্যাংকের ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ, আইএফআইসি ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ইস্টার্ন ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ, এনসিসির ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ, সাউথ ইস্ট ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংকের ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ, ডাচ্-বাংলায় ১০ দশমিক ৮১ শতাংশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ডে ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, এক্সিমের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ, প্রিমিয়ারে ১১ দশমিক ২৩ শতাংশ।
ফাস্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১১ দশমিক ০২ শতাংশ, যমুনা ব্যাংকের ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংকে ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ, মেঘনা ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংক ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, এরআরবি গ্লোবাল ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মধুমতি ব্যাংকের গড় ঋণের সুদহার ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক মো. নেহাল আহমেদ বলেন, সুদহার না কমার অন্যতম কারণ খেলাপি ঋণ। এটি কমাতে না পারলে সুদহার কমানো সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, ঋণগ্রহীতাদের উচ্চ সুদহার ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় বাধা, যা ঋণ পরিশোধে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উচ্চ সুদের কারণে পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়ে, যা রফতানিমুখী শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সুতরাং ঋণের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে আসা দরকার।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানায় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক নেহাল বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকার এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে, যা খেলাপি ঋণকে নিয়ন্ত্রণ এবং সুদহার কমাতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমানো, ঋণের গুণগত মান উন্নয়ন এবং যৌক্তিক মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সুদহার কমানো সম্ভব হবে।
এসআই/আরএস/জেআইএম