মতামত

ঝেঁটিয়ে শাড়ি বিদায়!

রেইসিজম, সেক্সিজম বা মেল্ শোভেনিজম- যাই বলেন না কেন, শাড়ি নিয়ে প্রথম আলোর ফরমায়েশি লেখা লিখতে গিয়ে কি অধ্যাপক আবু সায়ীদ শাড়ির প্রতি বাঙালি নারীর আজন্ম ভালোবাসাকেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করেননি? নাহলে শাড়ি নিয়ে লিখতে বসে শুধুই একজন পুরুষের চোখে দেখা বাঙালি নারী শরীরের খুঁতগুলো শোধরানোর ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে হবে কেন বিশ্বসাহিত্যের ফেরিওলাকে? তবে তিনি তার লেখায় শাড়ির বন্দনা করেছেন, না বেশ গুছিয়ে শাড়িকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন; সেটা অনেকটাই রাজনৈতিক বিষয়! কয়েকটি কারণ বলছি।

Advertisement

‘পাবলিক স্পিকিং’র প্রথম শর্ত হলো বক্তাকে ধরে নিতে হবে পাঠক বা শ্রোতাকে সর্বসাধারণ বলে গণ্য করতে হবে এবং কোনো শ্রেণির বিশেষ জ্ঞান বা বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না! এই লেখাটির ক্ষেত্রে সেই বিধি একেবারেই মানা হয়নি এবং বৈষম্যের সব তত্ত্বের বাইরেও লেখক তার সামাজিক দায়িত্ব অবহেলা করেছেন। সমাজের একজন ‘সিনিয়র সিটিজেন’, শিক্ষক ও তারুণ্যের আদর্শ হিসেবে তিনি বাঙালি নারী বলে যাদের সম্মোধন করেছেন তাদের কাউকেই কি তিনি যৌনাবেদন বাড়ানোর বা পোশাক নির্বাচনের মাধ্যমে শারীরিক কাঠামোগত ত্রুটি সারানোর পরামর্শ দানের অধিকার রাখেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন! তেমনি পাঠকও তার এই পরামর্শ নিতে আগ্রহী কি না সেটিও বিবেচ্য।

‘মানায় না’ শব্দ দুটি এই ইউনিসেক্সের যুগে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে, স্যার! এত এত বইয়ের আলোতেও আপনার চোখে যে কেন পড়েনি তাই ভাবছি। মেয়েদের নমনীয় বা কমনীয় হতে হবে- এই কথা একজন শিক্ষক বলতে পারেন না; কারণ এতে লিঙ্গভেদে বৈষম্যের পাশাপাশি স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাকে অস্বীকার করা হয়। একজন নারী নমনীয় হবে কি হবে না সেটা তার শারীরিক কাঠামো নয় বরং তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবস্থানই ঠিক করে দেবে। শাড়ি একটি পোশাক বই আর কিছু নয়, সেটি দিয়ে ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র- কোনোটিই বর্ণনা করা যায় না। নিতান্তই অভাবের কারণে শহুরে শ্রমিক মেয়েটির পরা অগোছালো শাড়িটিকে তিনি কোন আবেদন আর নান্দনিকতায় মাপবেন? সকাল থেকে রাত অব্দি সংগ্রাম করে চলা পোশাক শ্রমিক মেয়েটির অনিচ্ছায় পরিধেয় সস্তা সালোয়ার-কামিজেও তার আত্মনির্ভরশীলতার যে সৌন্দর্য, তা কি আবু সায়ীদের বর্ণিত সুরুচিসম্মত ও অনেক কষ্টে দেখা এক-আধ ডজন শুধুই সুন্দর মুখের চেয়ে কম?

পথে-ঘাটে এত এত যৌন নিপীড়নের মধ্যেও আধোউন্মুক্ত বা আধোবসনের যে প্রশংসা তিনি করেছেন, তাতেও যে বাঙালি মেয়েরা এখনও সুযোগ পেলেই শাড়ি পরে, তারা কি উচ্চতা ও গড়ন নিয়ে দেয়া খোঁটার কারণে বিতৃষ্ণা বোধ করবে না? সেটাই কি চেয়েছিলেন তিনি বা তার পত্রিকা? লেখক তার নিজের আশপাশে প্রায়শই দেখা এলিট শ্রেণির পাশ্চাত্য পোশাক-বিলাসকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলার মধ্য ও নিম্নবিত্ত ঘরের আপামর নারীদের ভুলেই গেছেন, যারা শুধু প্রয়োজনেই শাড়ি বা অন্যান্য সব পোশাকই পরে- হতে পারে দাম, পরিস্থিতি, সংরক্ষণ, আবহাওয়া, রুচি, পরিবেশ ও প্রয়োজন- যেকোনো বিবেচনায়! শুধু ওই বিতর্কিত আত্মতৃপ্তিটুকুই থাকে না তাতে! সেটুকু উনি যাদের মধ্যে পান, তারাই শুধু বাঙালি নারী নন। আবার, যতখানি সৌন্দর্য একজন নারীর শাড়ি পরিহিত রহস্যাবৃত শরীরে থাকে, অন্যসব পোশাক পরা একই শরীরে সেই নারীর সৌন্দর্য প্রকাশিত না হলেই বা কী যায় আসে? নারী কি শুধুই আবেদনময়ী, সুকুমার, তন্বী, মোহ বা মেকআপ লসের আঁধার? পোশাকের দায় দিয়ে নারীর ব্যক্তিসত্তাকে অন্যের মনোরঞ্জনের বিষয় করার মতো স্থূলতা একজন অধ্যাপকের কাছে অপ্রত্যাশিত।

Advertisement

এই বিশ্বায়নের যুগে, ডাইভার্সিটি বা বৈচিত্র্যের যুগে পৃথিবীর মানুষ যখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে দূরত্ব ঘুচিয়ে এনেছে তখন শাড়ি শুধুই আমাদের, স্কার্ট শুধুই তাদের- ভীষণ আলোকিত কেউ কি এসব কথা বিশ্বাস করেই বলেছেন? কোনটা অপরিশীলিত সৌন্দর্য আর কোনটি অকর্ষিত রুচি- সেটি কি এই লেখায় প্রকাশ পায়নি? যারা ছাপিয়েছেন তারা কি দায় এড়াতে পারবেন? শাহবাগ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নারীর চরিত্রকে হাতিয়ার করে সাহিত্য ছাপানো পত্রিকা কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাঙালি নারীর পোশাককে কৌশলে কলংকিত করার চেষ্টায় নেমেছেন? এটি আমাদের সংস্কৃতি, কল্পনায় দেখা মাতৃরূপ ও হাজার বছরের ঐতিহ্যকে করা ভয়ঙ্কর এক আঘাত; যেটি শুধু পহেলা বৈশাখকে বিতর্কিত করার সাথেই তুলনীয়!

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ/এমএস

Advertisement