প্রবাস

ফোবানা সম্মেলনের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ওয়াশিংটনের প্রতারকচক্র

আগামী ২০২১ সালে ৩৫তম ফোবানা সম্মেলনের ‘নিমন্ত্রণকর্তা (হোস্ট)’ হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বৃহত্তর ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার একটি শক্তিশালী প্রতারকচক্র। দীর্ঘদিন ধরে এ চক্রটি ফোবানা উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রিয় মিলনমেলা ‘ফোবানা সম্মেলন’র নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছে। অপসংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও ভূলুণ্ঠিত করছে এ চক্রটি।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের মিলনমেলা ‘ফোবানা সম্মেলন’ এখন চরম হুমকির মুখে। একদিকে অভ্যন্তরীণ স্বার্থান্বেষী মহল ও অন্যদিকে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র-এই দুই শ্রেণির নীল নকশায় ফোবানা সম্মেলন আজ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ৩০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া তিন দিনব্যাপী ৩৩তম ফোবানা সম্মেলন উত্তর আমেরিকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে যখন উৎসবমুখর থাকার কথা, ঠিক সেই সময়ে তারা নিজেরাই দ্বিধাবিভক্ত। তাই এবারের ফোবানা সম্মেলনের সফলতা ও সার্থকতা নিয়ে অনেকেই আশঙ্কাগ্রস্ত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একদিকে মূল ফোবানা সমর্থিত ‘ড্রামা সার্কেল, নিউইয়র্ক’ ৩৩তম ফোবানা সম্মেলন আয়োজনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। অন্যদিকে, ফোবানার মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া স্বার্থান্বেষী একটি মহলের সমর্থনে ‘বাংলাদেশ আমেরিকান ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি’ নামে একটি তথাকথিত সংগঠন নিউইয়র্ক শহরে উদ্দেশে পৃথক একটি ফোবানা সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। আর ধোঁয়াশাপূর্ণ পরিবেশ বিদ্যমান সংকটকে ব্যবহার করে স্বার্থন্বেষী একটি মহল তাদের নীল নকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

যখন সবাই ব্যস্ত ৩৩তম ফোবানা সম্মেলনের সফলতা নিশ্চিত করতে এবং উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশী সংগঠনগুলোকে একতাবদ্ধ করতে, তখন এই স্বার্থান্বেষী মহলটি কার্যত একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের হাতে পরবর্তী ফোবানা সম্মেলনকে তুলে দিতে ব্যস্ত। ওয়াশিংটন ডিসির এই সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের কেন্দ্রে রয়েছে ‘আমেরিকান বাংলাদেশ বিসনেস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি বাণিজ্যিক সংগঠন, যার নতুন নাম হয়েছে ‘বাংলাদেশ আমেরিকান ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি’। এই সংগঠনটি পূর্বেও স্বার্থান্বেষী মহলের সহযোগিতায় ২০০৯ ও ২০১১সালে দুইবার ফোবানা সম্মেলন আয়োজন করে যা ‘ভুয়া ফোবানা সম্মেলন’ হিসেবে পরিচিত রয়েছে।

Advertisement

ফোবানা সম্মেলনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তি ও প্রতারকচক্র সক্রিয় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সম্মেলনটিই যখন কুক্ষিগত হয় তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বাংলাদেশ আমেরিকান ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি নামক সংগঠনটির পরিচালক অথবা মূলব্যক্তি স্টল বরাদ্দ, বিজ্ঞাপনের অঙ্গীকার, ব্যবসায়িক অঙ্গীকার, ভুয়া কাগজে আদম আমদানি-এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যা ২০০৯ ও ২০১১ সালের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে তিনি করেননি।

শুধুমাত্র সম্মেলনের নামে এবং বিভিন্ন অজুহাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের থেকে এই প্রতারকচক্রটি বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে প্রবাসী রেজাউল করিমে কাছ থেকে ১০ হাজার, গোলাম ফরিদ আক্তারের কাছ থেকে ১২ হাজার, রফিকুল ইসলামে কাছ থেকে ৭ হাজার, জাকির হোসেন কাছ থেকে ১৫ হাজার, রুমনের কাছ থেকে ২৩ হাজার, শামীম আলীর কাছ থেকে ৩৯ হাজার ও মাইনুল ইসলাম তাপসের কাছ থেকে ৭ হাজার মার্কিন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।

এমনকি ফোবানা সম্মেলন শেষ করে ভেন্যু ভাড়া না দিয়ে শুধুমাত্র ফোবানা সম্মেলন নয় বরং পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটির মুখে চুনকালি লেপ্টে দিয়েছে এই প্রতারকরা। পরবর্তীতে ফেডারেল কোর্টে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে পিটিশন দাখিল করেছে সংগঠনটির পরিচালক। আলেকজান্দ্রিয়া ফেডারেল কোর্ট তাকে এবং তার স্ত্রীকে দেউলিয়া ঘোষণা করে রায় দিয়েছে।

ওই ব্যক্তির প্রতারণা শুধু ফোবানা সম্মেলনকে কেন্দ্র করেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতারণাই তার পেশা। কখনও তিনি ব্যবসার কথা বলে প্রতারণা করেন, কখনও রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে কখনও বা সমাজ সেবা বা ধর্মের নামে প্রতারণা করেন বলে ভুক্তভোগীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন।

Advertisement

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এ প্রতারক্রটি উত্তর আমেরিকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের ব্যবসার কথা বলে ও ব্যবসায় অংশীদারত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে তার ফাঁদে ফেলেছে। যার মধ্যে নাইমা রহমানের কাছ থেকে ২৬ হাজার, পিপলস অ্যান্ড টেকের আবু হানিফের কাছ থেকে ১৮ হাজার, মেজর আলমের কাছ থেকে ২০ হাজার, ড. রাজ্জাকে কাছ থেকে ৮০ হাজার মার্কিন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো ড. রাজ্জাকের ঘটনা । তার স্ত্রী ড. নাজমা জাহান থেকে জানা যায়, ড. রাজ্জাক এই প্রতারককে কয়েক দফায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দেয় ব্যবসায়িক কারণে। পরবর্তীতে যখন তিনি বুঝতে পারেন তিনি এক সংবদ্ধ প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন, তখন তার আর করার কিছু ছিল না। ড. রাজ্জাক মানসিকভাবে প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েন এবং এই মানসিক যন্ত্রণায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

এই প্রতারক চক্রটি এতটাই চতুর যে তার খপ্পরে যে পড়ে সে নিঃস্ব না হওয়া পর্যন্ত তার জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ‘বাংলাদেশ আমেরিকান ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি’র পরিচালক মসজিদ উন্নয়ন তহবিলে অনুদানের কথা বলে আলেকজান্দ্রিয়া বাংলাদেশি কমিউনিটির মসজিদ উন্নয়ন তহবিল থেকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ ছাড়াও বাংলাদেশে অনেক দরিদ্র পরিবারকে উত্তর আমেরিকায় এনে কাজ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবারগুলোকে সর্বশান্ত করেছেন।

যারা ফোবানার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত তাদের সকলেই কমবেশি জানে এ চক্র সম্পর্কে। কিন্তু এতকিছু জেনেও ফোবানার অভ্যন্তরীণ একটি স্বার্থান্বেষী মহল শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য ফোবানা সম্মেলনকে আবার এই প্রতারকের হাতে তুলে দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ প্রতারক তার কুকীর্তির আড়াল করতে তার মতো আরও কয়েকটি পকেট সংগঠনকে নিয়ে একটি আয়োজক গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। আর শিকড়বিহীন ব্যাঙের ছাতার মতো এ সংগঠনগুলো কখনও সামাজিক আন্দোলন বা সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না। তাই তাদের থেকে প্রবাসীদের আরও সজাগ থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

এসআর/পিআর