আন্তর্জাতিক

রাষ্ট্রহীন ১৯ লাখ মানুষের ভাগ্যে কী ঘটবে?

শনিবার দুপুরে যখন জানতে পারেন, চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় (এনআরসি) তার নাম নেই, আতঙ্কে আর অনিশ্চয়তায় মুষড়ে পড়েছেন আসামের গৌহাটির গৃহবধূ জমিরন পারভিন।

Advertisement

বিবিসির অমিতাভ ভট্টশালী দুপুরের দিকে গৌহাটিতে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখতে পান, কিছুক্ষণ পরপরই চোখ মুছছেন জমিরন। স্বামী আজম আলী মৃধা এবং শ্বশুর বাড়ির অন্যান্যরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

আট-নয় বছরের একমাত্র ছেলে বাচ্চাটি উদ্বিগ্ন হয়ে মাকে দেখছে। স্বামী-সন্তান এবং শ্বশুর বাড়ির সবারই চূড়ান্ত তালিকায় নাম রয়েছে। বাবার পরিবারের সবাই তালিকায় রয়েছেন। বাদ পড়েছেন একমাত্র তিনি।

বিবিসিকে জমিরন বলেন, খসড়া তালিকায় নাম না ওঠার পর সব সমস্ত কাগজ-পত্র দিয়ে আপিল করেছিলাম। কিন্তু তারপরও নাম নেই। জানি না এখন আমার কি হবে। জমিরনের জন্ম আসামের বড়পেটায়। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রবেশপত্রে জমিরনের বাবার নামের বানান ভুল লেখা হয়েছিল বলেই এই পরিণতি। তার বাবার নাম আতব আলী, কিন্তু পরীক্ষার প্রবেশপত্রে নাম লেখা হয় আতাবর আলী।

Advertisement

আর এই দুই অক্ষরের ভুলেই চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন এই নারীর। জমিরনের স্বামী জানালেন, তারা ট্রাইবুনালে আপিল করবেন। জমিরন পারভিনসহ আসামের ১৯ লাখেরও বেশী মানুষের নাম চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।

এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে এই ১৯ লাখ বাংলাভাষী মানুষের, যাদের সিংহভাগই মুসলমান, এখন কী হবে। তারা কি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়লেন? এখনই সেটা তারা হচ্ছেন না । বাদ পড়া এই মানুষদের আপিলের জন্য ১২০ দিন সময় দেয়া হয়েছে।

বিশেষভাবে তৈরি ট্রাইবুনাল ছাড়াও তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টেও আপিল করতে পারবেন। তবে ভারতের সমস্ত আদালতগুলো এমনিতেই সারা বছরই মামলার চাপে পর্যুদস্ত। ফলে আদালতে গিয়ে দীর্ঘ, জটিল এবং ব্যয়বহুল আপিল প্রক্রিয়ার সুবিধা কতজন নিতে পারবেন তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বিস্তার সন্দেহ রয়েছ।

বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র, অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষগুলোর জন্য এই আপিল প্রক্রিয়ায় ঢোকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ফলে যারা আপিলে অসফল হবেন বা এই প্রক্রিয়াতে ঢুকবেনই না, তারা রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়বেন - সে সম্ভাবনাই প্রবল।

Advertisement

ট্রাইবুনালের প্রতি আস্থার অভাব

আসামের লেখিকা সঙ্গিতা বড়ুয়া পিশারডি বিবিসিকে বলেন, যাদের নাম চূড়ান্ত তালিকাতে নেই তারা অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যে তাদের এখন কী হবে। তার প্রধান কারণ ফরেনার্স ট্রাইবুনালের ভাবমূর্তি ভালো না, মানুষের আস্থা নেই। ফলে সেখানে গিয়ে আদৌ কাজ হবে কিনা তা নিয়ে বহু মানুষ সন্দিহান।

নাগরিকত্ব নির্ধারণে আসামে, এখন এ ধরনের ২০০টি বিশেষ আদালত বা ট্রাইবুনাল রয়েছে যেগুলোর অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর। অক্টোবরের মধ্যে এ ধরনের ট্রাইবুনালের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০০।

এ সব আদালতের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের বিস্তর অভিযোগ রয়েছ। তাদের কাজের মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতাও নেই। সবচেয়ে বড় কথা প্রমাণের সমস্ত দায় বর্তায় বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত ব্যক্তির ওপর।

লাখ লাখ দরিদ্র, নিরক্ষর মানুষের কাছে সবকিছুর লিখিত রেকর্ডও নেই। সাংবাদিক রোহিনী মোহন আসামের একটি জেলায় এসব ট্রাইবুনালের ৫০০টিরও বেশি রায় বিশ্লেষণ করে দেখতে পান ৮২ শতাংশ অভিযুক্তকেই বিদেশী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ৭৮ শতাংশ রায় হয়েছে অভিযুক্তের বক্তব্য না শুনেই।

বলা বাহুল্য বিদেশী হিসাবে ঘোষিত এসব মানুষদের সিংহভাগই মুসলমান। তবে বাংলাভাষী হিন্দুর সংখ্যাও কম নয়। এমনকি মোহাম্মদ সানাউল্লাহ নামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক এক সদস্য, যিনি তার কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তাকে পর্যন্ত বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত করে ১১ দিন আটকে রাখা হয়েছিল। বিবিসি বাংলা।

এসআইএস/এমএস