অর্থনীতি

খেলাপিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ৯ ব্যাংক

নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিতরণের কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এতে বিপাকে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি খাতের ৯ ব্যাংক। তাদের কারো মোট বিতরণ করা ঋণের ৪০-৯০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে, যার কারণে ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে অনেকে। কেউ কেউ মূলধনও ভেঙে খাচ্ছে।

Advertisement

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে চারটি সরকারি, চারটি বেসরকারি ও একটি বিদেশি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে।

চলতি বছরের ৩০ জুন সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, বিডিবিএল, জনতা ও সোনালী, বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ও এবি ব্যাংক এবং বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি)।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৬০ দশমিক ৫০ শতাংশ খেলাপি। চলতি বছরের জুন শেষে বেসিক ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৯ হাজার ১১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতিও সবচেয়ে বেশি, যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) অবস্থাও নাজুক। প্রতিষ্ঠানটির এক হাজার ৫৯১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বিতরণ করা ঋণের ৫৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা ৮৯০ কোটি টাকা খেলাপি।

Advertisement

পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকে। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা মোট ঋণের ৪২ দশমিক ৯৬ শতাংশ বা ২০ হাজার ৯৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা খেলাপি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি থাকা ব্যাংক হলো সোনালী ব্যাংক। এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা বা ২৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ব্যাংকটির ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির এক হাজার ৯৪২ কোটি ২০ লাখ।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৮২ দশমিক ৬৪ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ দশমিক ৭০ শতাংশ আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ব্যাংকটির ৮৫৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা মোট ঋণের মধ্যে ৭০৭ টাকা খেলাপি। পদ্মা ব্যাংকের (ফারমার্স ব্যাংক) মোট ঋণের ৬৬ শতাংশ খেলাপি। জুন শেষে মোট ৫ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৩ হাজার ৬১১ কোটি টাকাই খেলাপি। ব্যাংকটি বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্র খাতের পাঁচটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মোট ঋণের ৪৪ দশমিক ৫৯ শতাংশই খেলাপি। ব্যাংকটি ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৯৭ কোটি টাকাই খেলাপি ঋণ। ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশই আদায় অযোগ্য ঋণ। ফলে ব্যাংকটি ৫১১ কোটি টাকার প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। জুন শেষে এবি ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৮ দশমিক ১১ শতাংশ খেলাপি। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা।

এদিকে আলোচিত সময়ে শতাংশের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি)। ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৭ দশমিক ৬৪ শতাংশই খেলাপি ঋণ। এক হাজার ৪২৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আগের বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। আগের প্রান্তিক জানুয়ারি থেকে মার্চ এ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

Advertisement

আলোচিত সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লেও সরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। এতে শতকরা হিসাবে সার্বিক ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার কমেছে। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা জুনে হয়েছে ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

এদিকে খেলাপি বেড়ে যাওয়ায় দেশের ব্যাংক খাতে ধস অব্যাহত রয়েছে। ধারাবাহিক বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করছে দাতা সংস্থা ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)’।

সম্প্রতি আইএমএফ’র এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডাইসাকু কিহারা জানান, বাংলাদেশের অর্থনীতি এগুলেও ব্যাংক খাতে ধস নামছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। খেলাপি ঋণ কমাতে টাইম-বাউন্ড কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। ব্যাংকিং সুপারভিশন বাড়াতে হবে, খেলাপিদের আইনি সহায়তা বন্ধ করতে হবে।

তিনি বলেন, খেলাপিদের পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন নীতিমালা আরও কঠোর করা দরকার। সবক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ব্যাংকসহ সব ব্যাংকে সংস্কারের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে বলে জানান আইএমএফ কর্মকর্তা।

এসআই/এএইচ/জেআইএম