পর্যটন শহর কক্সবাজারের সবচেয়ে পরিচিত সৈকত লাবণী পয়েন্ট। এ পয়েন্টের জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রণাধীন বিচ পার্কের জমিতে ১০ তলা ভবনের নতুন সার্কিট হাউস নির্মাণ করতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের অনুমোদন চেয়ে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) কাছে চিঠি দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
Advertisement
কিন্তু সৈকতের বালিয়াড়ির অতি নিকটে বিচ পার্কের জমিতে সার্কিট হাউস নির্মাণের উদ্যোগের শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছে জেলা পরিষদ ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। বহুতল এ ভবনটি এখানে না নির্মাণ করে বিকল্প স্থানে নির্মাণের প্রস্তাবও দিয়েছে তারা।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে ১০ তলা ভবনের নতুন সার্কিট হাউস নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসকের প্রস্তাবিত প্রকল্পের অনুমোদন দিতে গত ৬ আগস্ট গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নায়লা আহমেদ স্বাক্ষরিত এক পত্র কউক বরাবর পাঠানো হয়। পত্রে উল্লেখ রয়েছে, মামলা-সংক্রান্ত জটিলতা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা নিষ্পত্তি করবে। চিটি আসার পরই গত কয়েকদিন আগে জেলা পরিষদের শিশু পার্কের সাইনবোর্ড সরিয়ে নেয়া হয় বিচ পার্ক এলাকা থেকে।
২০০৭ সালে জরুরি সরকারের আমলের সময় শতাধিক দোকান বিশিষ্ট ঝিনুক মার্কেট, মসজিদ ও পার্শ্ববর্তী বসতি সরিয়ে এখানে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘বিচ পার্ক’ নামে হাটা চলা ও নির্মল হওয়া উপভোগের একটি পার্ক। জেলা পরিষদের কর্তৃত্বাধীন এ জমিতে একটি শিশু পার্ক নির্মাণের প্রস্তাবও দিয়েছিল তারা। তবে জেলা প্রশাসন এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে।
Advertisement
এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সেখানে কীভাবে তারা (জেলা পরিষদ) শিশুপার্ক করবেন? এটা তো তাদের জায়গা না। খাস খতিয়ান মূলে এই জায়গা জেলা প্রশাসনের।
তিনি বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত দিলে সেখানে সার্কিট হাউস হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের তরফ থেকে এখানে সার্কিট হাউসের নতুন ভবনের প্রথম প্রস্তাবনা আসে। সে সময় লাবণী পয়েন্টে সার্কিট হাউস নির্মাণ করা সমীচীন হবে না বলে মতামত দিয়েছিলেন কক্সবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাক আহমদ চৌধুরী ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ। ফলে তখনই উদ্যোগটি থেমে যায়। কিন্তু সম্প্রতি এ বিষয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি অনুরোধপত্র আসার পর এনিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
সৈকতের পার্ক প্রকল্প বাতিল করে সার্কিট হাউস নির্মাণের উদ্যোগকে সমর্থন করেন না কক্সবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাক আহমদ চৌধুরী।
Advertisement
তিনি বলেন, লাবণী সৈকতে জেলা পরিষদের মালিকানাধীন উদ্যানটিতে পর্যটক এবং স্থানীয় শিশু-কিশোরদের জন্য একটি মিনি শিশু পার্ক করার প্রস্তাবনা আমরা বহুদিন আগেই দিয়েছিলাম। সেখানে আরেকটি অংশে থাকবে স্বাস্থ্যকর উদ্যান।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আরো বলেন, সাবেক পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন যখন এখানে (লাবণী সৈকতে) ১০ তলা ভবনের সার্কিট হাউস নির্মাণের প্রস্তাবণা তুলেন তখনই জানিয়েছিলাম দশতলা ভবনের জন্য এটি উপযুক্ত স্থান নয়। বরং সেটা অন্যকোনো স্থানে নির্মাণ করে লাবণী সৈকত এবং সংলগ্ন স্থান উন্মুক্ত রাখাই হবে সমীচীন হবে বলে, পরামর্শ দিই।
কক্সবাজার সৈকতের বিচ পার্কের জমিতে ১০ তলা বিশিষ্ট সার্কিট হাউস নির্মাণের বিরোধিতা করেন স্থানীয় নাগরিক সমাজও।
কক্সবাজারের সাবেক জমিদার ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোপাল দাশ বলেন, এমনটি হয়ে থাকলে কক্সবাজার শেষ করার আর বাকি রইল কী?
ষাটোর্ধ্ব এ নাগরিকের মতে, এক সময় উম্মুক্ত সৈকত ও বালিয়াড়ির দৃষ্টিনন্দন লতাপাতা পর্যটকদের চোখ জুড়াতো। কিন্তু বিভিন্ন বাহিনীর স্থাপনা, ঝুপড়ি দোকান ও সাগরের ভাঙনে উম্মুক্ত সৈকতের পরিধি দিনদিন কমে আসছে। সেখানে এসব স্থাপনা হলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা বেঁচে থাকতে নিজ শহরের এমন ক্ষতির কাজ কাউকে করতে দিতে পারি না।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের নেতা রাশেদুল ইসলাম বলেন, পরিকল্পিত কক্সবাজার হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কেউ তা বাস্তবায়ন করছে না। এখন থেকে পরিকল্পনার বাইরে এমন কোনো কিছু করতে দেয়া উচিত হবে না; কারণ এটা পর্যটন শহর।
কক্সবাজার জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান মফিজ বলেন, আমরা এমন স্থাপনা চাই না। বিচ থেকে ৩ কিলোমিটার পর্যটকদের জন্য উম্মুক্ত রাখতে হবে, সেখানে কোনো স্থাপনা আমরা কক্সবাজারবাসী মানি না, মানবোও না। পর্যটনের ঐতিহ্য অনেক জায়গা বেহাত হয়েছে। এখন আর না।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ বলেন, সৈকতের বালিয়াড়ির অতি নিকটে কোনো স্থাপনা না করতে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বর্তমানে পর্যটন শহরকে পরিকল্পিতভাবেই সাজাতে কাজ করছে কউক। যে কোনো ধরনের পরিকল্পনা সন্তর্পণে অবলোকন করা হবে। কারণ কক্সবাজার সৈকত জাতীয় সম্পদ।
সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/জেআইএম