আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তালিকা থেকে বাদ পড়ছে ১৯ লাখের বেশি মানুষ। শনিবার সকাল ১০টায় বহু প্রতীক্ষিত এই তালিকা প্রকাশ করা হলো। এনআরসি সেবা কেন্দ্র ও সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে এই তালিকা। এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় ৩ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৪ জনের নাম অন্তর্ভুক্তি হয়েছে।
Advertisement
অপরদিকে ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম বাদ পড়েছে চূড়ান্ত তালিকা থেকে। তবে গত বছরের ৩০ জুলাই ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স (এনআরসির) তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল প্রায় ৪০ লাখ আবেদনকারীর নাম। এরা সবাই বাঙালি এবং বেশিরভাগই মুসলিম। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল তাদের।
চলতি বছরেও প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার আবেদনকারীর নাম পড়েছে। এনআরসির তালিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে যেন কোনো ধরনের অস্থিরতা তৈরি না হয় সে কারণে আসামজুড়েই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই গুয়াহাটিসহ রাজ্যের উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
এনআরসি তালিকায় নাম উঠেছে কি-না তা এনআরসি সেবা কেন্দ্র অথবা সার্কেল অফিসারের অফিস কিংবা ডেপুটি অফিসারের অফিসে গিয়ে দেখা যাবে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে এই তালিকা দেখা যাবে।
Advertisement
আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স বা এনআরসির প্রথম তালিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। সেটা ছিল ভারত ভাগের চার বছর পর। সে সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর লাখ লাখ লোক সীমান্ত অতিক্রম করে নবগঠিত ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিপুল সংখ্যক মুসলমানদের আগমন হিন্দু-প্রধান আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্যকে বদলে দিতে পারে এই আশঙ্কায় সেখানকার অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলো আন্দোলন শুরু করে এবং নাগরিকত্বের প্রথম তালিকাটি তৈরি হয়।
এই সমস্যা আবার দেখা দেয় ১৯৭০ সালে যখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে যায়। এদের একাংশ আসামে আশ্রয় নেয়।
অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) ১৯৭৯ সালে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৩ সালে এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। এতে দুই হাজার সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসী প্রাণ হারান। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান।
Advertisement
আসু এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দল এই প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসে। ওই চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে আসামের বাসিন্দা, কেউ এমনটা প্রমাণ করতে না পারলে তাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। আর তাকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু চুক্তিটি কখনই বাস্তবায়ন করা হয়নি।
অভিজিৎ শর্মা নামের এক ব্যক্তি ২০০৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোটের কাছে এক পিটিশন দায়ের করেন এবং এনআরসি তালিকা হালনাগাদ করার আবেদন করেন।
২০১৪ সালে আদালত ওই তালিকা ২০১৬ সালের ৩১শে জানুয়ারির মধ্যে হালনাগাদ করার জন্য কেন্দ্র সরকারকে আদেশ দেয়। কিন্তু এটা ছিল দুঃসাধ্য। কারণ এতে তিন কোটি ২০ লাখ মানুষের দলিলপত্র যাচাই করার ব্যাপার রয়েছে। এই কাজ শেষ করে সরকার ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রথম খসড়া তালিকা প্রকাশ করে।
যাচাই বাছাইয়ের পর ওই খসড়ার দ্বিতীয় তালিকাটি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই। এনআরসিতে যাদের নাম রয়েছে তারা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে তারা আসামে এসেছেন।
নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য রাজ্যের সব অধিবাসীকে তাদের জমির দলিল, ভোটার আইডি এবং পাসপোর্টসহ নানা ধরনের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়েছিল। এনআরসি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে যে, তালিকা থেকে বাদ পড়া বহু লোকের কাছে তারা চিঠি পাঠিয়েছে এবং কাছের অফিস বাদ দিয়ে বহু দূরের অফিসগুলোতে গিয়ে তাদের কাগজপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
স্থানীয় ভারতীয় কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, তারা মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছেন না। তবে এনআরসির প্রধান প্রতীক হাজেলা বিবিসির কাছে স্বীকার করেছেন যে, যারা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন তারা ভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষ।
টিটিএন/জেআইএম