ডেঙ্গু আতঙ্ক কাটছেই না। প্রতিদিনই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অসংখ্য রোগী ভর্তি হচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৭১ হাজারে। আর এদের চিকিৎসা বাবদ খরচ হবে ২৭৮ কোটি টাকা।
Advertisement
তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের অর্থ মন্ত্রলায়ের বরাদ্দ অর্থ এ হিসাবের আওতায় আনা হয়নি। সেই সঙ্গে সরকারি হিসাবের বাইরে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদেরকেও এই হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। তার ছয়জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই গবেষণা করছেন তিনি। গবেষণার জন্য তারা ঢাকার হাসপাতালগুলো থেকে ডেঙ্গু রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করছেন।
বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) অধ্যাপক আব্দুল হামিদ ডয়চে ভেলেকে সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে গবেষণার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি।
Advertisement
আব্দুল হামিদ বলেন, গবেষণাটা এখনও চলছে। যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছেন, তাদের কতো খরচ হয়েছে সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের হিসাবে খরচটা খুব বেশি না। তবে সব ধরনের খরচ হিসাব করলে এই খরচ বড় হবে। রোগীর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, খাবার ও হাসপাতালে আসার খরচ, দুজন অ্যাটেনডেন্টের কর্মঘণ্টা এবং যারা মারা গেছেন মাথাপিছু আয় ধরে তাদের অর্থনৈতিক ভ্যালু অ্যাড করে এই খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারি হিসাবের বাইরে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদেরকে এই হিসাবের মধ্যে আনা হয়নি। এছাড়া হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন, জ্বর হওয়ার পর আতঙ্কিত হয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছেন, মশা মারার ওষুধ কিনেছেন এবং ডেঙ্গু আতঙ্কে যাদের মানসিক ট্রমা হয়েছে তাদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার খরচও এই হিসাবের মধ্যে আনা হয়নি।
অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলছেন, এবার ডেঙ্গুতে বেশি মারা গেছে ৩০ বছরের কম বয়সীরা। সরকারি হিসেবে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ আগস্ট ৫১ হাজার ৫০০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোকে একটি শ্রেণিতে রেখে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ‘এ’ এবং ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে খরচের চিত্র তুলে আনা হয়।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের ছয় থেকে আট দিন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজার ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন, এদের গড়ে খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করে। ‘এ’ ক্যাটাগরির বেসরকারি হাসপাতালে একেকজন ডেঙ্গু রোগীর খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা। আর ‘বি’ ক্যাটাগরির বেসরকারি হাসপাতালে এই খরচ ছিল সাড়ে ৫৩ হাজার টাকা। সেই হিসাবে গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত মোট খরচ দাঁড়িয়েছে ২০৪ কোটি টাকা।
Advertisement
অধ্যাপক হামিদ বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এই হার বিবেচনা করলে আগস্টের শেষে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৭১ হাজার, আর খরচ ঠেকবে ২৭৮ কোটি টাকায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গু বাড়ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হামিদ বলেন, আগে টানা বৃষ্টি হয়ে সবকিছু ধুয়ে-মুছে নিয়ে যেত। এখন দেখা যায়, একটু বৃষ্টি হয়ে আবার তিনদিন বৃষ্টি নেই। ফলে পানি জমে থাকে, আর এই পরিষ্কার পানিতেই এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের এই ধারা অব্যাহত থাকবে। এজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। ডেঙ্গু কেন হচ্ছে এবং এটা নিয়ন্ত্রণে পারিবারিকভাবে কী করতে পারি, সমন্বিতভাবে সেই প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ডেঙ্গু কেন হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে এটার সায়েন্টেফিক অ্যানালাইসিস আছে আরও অ্যানালাইসিস (বিশ্লেষণ) করে যেসব কারণে ডেঙ্গু হচ্ছে সেখানে হাত দিতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ জানিয়ে অধ্যাপক হামিদ বলেন, আমরা প্রচুর পলিথিন ব্যবহার করছি, ময়লা আবর্জনা ঠিকমত পরিষ্কার করা হয় না। এ বিষয়ে সামাজিকভাবে সবাইকে সচেতন করতে হবে, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি স্থাপনা যেমন- থানায় পুরাতন গাড়ি বছরের পর বছর জমে আছে, হাসপাতালে বহু পুরনো জিনিসপত্র জমা হয়ে থাকে, সেখান থেকে মশা ছড়াতে পারে। কনস্ট্রাকশন খাতেও এটা হচ্ছে।
অধ্যাপক হামিদ বলেন, সবকিছুকে নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করতে হবে। ডেঙ্গু কেন হচ্ছে, কীভাবে এর বিস্তার হচ্ছে, সামনে এই পরিস্থিতি কোথায় পৌঁছাতে পারে- এসব বিষয় মাস্টারপ্ল্যানে থাকতে হবে। সেখানে বিশেষজ্ঞদের মতামতও থাকতে হবে। এটা না করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলেন, সেখানে (মফস্বলে) ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সেখানকার রোগীদের অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ার পর তাদের ঢাকায় আনা হচ্ছে, এতে তাদের খরচ আরও বাড়ছে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দিতে হবে, সেখানে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে, ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশেষ করে রোগীর প্লাটিলেট কমে যখন ২০ হাজারের কাছাকাছি চলে আসে, তখন সব রোগীকে কিন্তু ওখানেও রক্ত দেয়া যেত, এটা না করে ওইসব রোগীকে ঢাকায় আনা হচ্ছে। ফলে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জায়গা হচ্ছে না।
অধ্যাপক হামিদ বলেন, পুরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রিপোর্ট চূড়ান্ত করতে এক মাস সময় লাগবে। এরপর একটি কর্মশালার আয়োজন করা হবে। প্রতিবদনটি জার্নালে প্রকাশের চেষ্টা করা হবে এবং সরকারের বিভিন্ন অথরিটিকে তা রিপোর্ট আকারে দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
সূত্র : ডয়েচে ভেলে
এমএসএইচ/এমএস