দেলোয়ার এইচ রাইন
Advertisement
শিল্প ও সংস্কৃতি হল একটি জাতির মূল চালিকাশক্তি। শিল্প-সংস্কৃতির অবস্থান দেখে একটি জাতি সভ্য কি বর্বর তা নিরুপণ করা যায়। কোন জাতি যদি সংস্কৃতিতে উন্নত না হয় সে জাতি যতই সম্পদে, অর্থনীতিতে শক্তিশালী হোক না কেন, সে জাতি কখনোই সত্যিকারের উন্নতির স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না। সংস্কৃতি মানুষকে উন্নত চরিত্র গঠনে ব্যাপক ভাবে সহায়তা করে। নিজের চোখ দিয়ে অন্যের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না , মিলন-বিরহ, চাওয়া-পাওয়া প্রভৃতি দেখার সক্ষমতা তৈরি হয়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক, মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার চোখ দিয়ে তিনি বাঙালির সত্যিকারের অবস্থা অবলোকন করেছিলেন। শত সহস্র বছর ধরে এই পদ্মা-মেঘনা-যমুনার অববাহিকা সংবলিত ব-দ্বীপ শাসন করেছেন মুঘল সম্রাটেরা, শাসনের নামে শোষণ করেছেন পাঠানরা, পর্তুগীজ বেনিয়ারা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে ব্রিটিশরা। সেই ব্রিটিশ শাসনামলেই কিশোর মুজিব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এই শাসকেরা বাঙালির সত্যিকারের মঙ্গল চায় না। তারা প্রত্যকেই নিজদের স্বার্থ আর আখের গোছানোর জন্য দারিদ্র-পীড়িত বাঙালি জাতির উপর শাসনের নামে সব সময় শোষণই করে চলেছেন।
এই অঞ্চলের মানুষ উন্নত হোক, এই অঞ্চলের মানুষের উন্নত সংস্কৃতির চর্চা হোক এটা কোন শাসকেরাই চায়নি। কিশোর বয়সে শেখ মুজিব যখন টুঙ্গিপাড়াসহ বিভিন্ন জনপদে ঘুরে বেড়াতেন তখনই তিনি গভীর মনোযোগের সাথে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এই সমস্ত জনপদের মানুষের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য আর মানুষের চোখে-মুখে এই হাজারো বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার এক নীরব মিনতি। তাইতো যখন ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হল তার এক বছরের মাথায় বুঝতে পারলেন এ পাকিস্তান আমার দেশ না। যে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে তা কখনোই আমার বাঙালির ভাগ্য-উন্নয়নে কাজ করবে না। কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর অনুমানই ঠিক হল। পাকিস্তানি শাসকেরা নতুন করে পূর্ব-পাকিস্তানিদের শোষণ করা শুরু করল। তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয়, রাজনৈতিক সহ সকল ক্ষেত্রে পুর্ব পাকিস্তানিদের গলা টিপে ধরেছিল।
Advertisement
পাকিস্তানি শাসকেরা অনেক সূদুরপ্রসারী চিন্তা করে এই বাংলার হাজার বছরের যে চেতনা, যে সংস্কৃতি তা ধ্বংস করার জন্য হীন চক্রান্তে মেতে উঠেছিল। এজন্য তারা বাংলার পরিবর্তে উর্ধুকে রাষ্ট্র-ভাষা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখনই শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন কোন ভাবেই আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করতে দেওয়া যাবে না। তিনি বাংলাকে রক্ষা করার জন্য দীর্ঘ-মেয়াদী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। এজন্য তিনি প্রথমেই মাত্র ২৮ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলেন। এরপর ছাত্রলীগকে ভার দিলেন পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ এই তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠা রক্ষার আন্দোলন করে শেষ পর্যন্ত বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে পেরেছিল।
ভাষা আন্দোলনের ওই সময়ে একটি ঘটনার মাধ্যমে মাতৃভূমি-মাতৃভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে গভীর অনুরাগ ছিল তা সহজেই লক্ষ্য করা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের দ্বারোদঘাটন করার একটি অনুষ্ঠানে তখনকার ফুড ডিপার্টমেন্টের ডাইরেক্টার জেনারেল এন এম খানসহ বঙ্গবন্ধুকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। সেখানে বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদকেও আমন্ত্রণ করা হয়েছিল গান গাওয়ার জন্য। সেদিন এন এম খান ও আব্বাসউদ্দিন কে দেখার জন্য হাজার হাজার লোক সমবেত হয়েছিল।
বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাস উদ্দিন সাহেব বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তার গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তার গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তার নাড়ির সম্বন্ধ। অনুষ্ঠানের পরের দিন নৌকায় আব্বাস উদ্দিনসহ অন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু রওয়ানা হলেন আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চললো। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তে লিখেছেন – “নদীতে বসে আব্বাস উদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলি যেন তার গান শুনছে।
তারই শিষ্য সোহরার হোসেন ও বেদার উদ্দিন তার নাম কিছুটা রেখেছিলেন, আমি আব্বাস উদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বললেন মুজিব বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হযে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।” এমনি ইস্পাত কঠিন সংকল্প ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি সেদিন আবহমান বাংলার চালিকা শক্তি নৌকায় বসে মরমী শিল্পী আব্বাসউদ্দিন কে যে কথা দিয়েছিলেন তা তিনি রাখতে পেরেছিলেন।
Advertisement
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, উপন্যাস নাটক সমস্তকিছুই বঙ্গবন্ধু খুব ভালবাসতেন। রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি ছিল বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয় একটি গান। বাংলার উন্নয়নে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন পাস করলেন। বাংলা মায়ের বুক চিড়ে যেন দু-ভাগ করলেন। সেই আঘাত কশাঘাত হয়ে বুকে বিধল বাংলার কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের বুকে। বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় এই বাংলা, বাঙালির প্রতি বিশ্বকবির গভীর মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল আমার সোনার বাংলা গানটিতে। সেই গানটিই আমাদের বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে চিরস্থায়ী বাসা করে নিল।
বঙ্গবন্ধু অবসরে প্রায়ই এই গানটি সুর করে গাইতেন। তাঁর সাথে যখনই কোন শিল্পী থাকত তিনি তখন আমার সোনার বাংলা গাওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তিনি শিল্পীদের এই গানটি গাওয়ার জন্য বলতেন। কে জানে, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হলে এই গানটিকেই জাতীয় সংগীত করবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যখন দেশমাতৃকা স্বাধীন হল, প্রথমেই বঙ্গবন্ধু আমার সোনার বাংলাকে জাতীয় সংগীত করলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা যায় সেদিন বঙ্গবন্ধুর চোখে-মুখে তৃপ্তির কী যে আশ্চর্য ঝিলিক!
বঙ্গবন্ধুর সাথে এ দেশের চিত্রশিল্পীদের ছিল নিবিড় যোগাযোগ। জসীমউদদীন, সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, হাশেম খান, সমরজিৎ রায়চৌধুরী প্রমুখ কবি ও চিত্রশিল্পী এবং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ছিল পারিবারিক যোগাযোগ। ১৯৭৩ সালে তাঁর সঙ্গে ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোর সাক্ষাৎ হয়। ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “মানবাত্মার সুদক্ষ প্রকৌশলী হচ্ছেন দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী।” এ জন্য তাঁদের প্রতি তাঁর প্রাণের এত টান! অসুস্থ কবি হুমায়ূন কাদির, আবুল হাসান ও মহাদেব সাহাকে সুচিকিৎসার জন্য বার্লিন, মস্কো, লন্ডন পাঠান তিনি।
কবি দাউদ হায়দারকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা এবং নিরাপত্তা দিয়ে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কবি আল মাহমুদকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিয়োগ দেন শিল্পকলা একাডেমিতে। তিনি প্রথম যে বার রাশিয়া সফরে গেলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এর জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় উপঢৌকন হিসেবে এদেশের চিত্রশিল্পীদের দিয়ে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি দেশের প্রতিথযশা চিত্রশিল্পীদের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে সম্মান জানাতেন।
যে নেতা সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন, জীবনের দীর্ঘ তেরটি বছর জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্টে কাটিয়েছেন, দুখী-দরিদ্র আর নিচু-তলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন সেই মহান নেতা আরেক দুঃখ,দারিদ্র্যের কবি, সত্য আর ন্যায়ের কবি, মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও ছিল তাঁর অত্যধিক প্রিয়। তাইতো ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পরপরই কাজী নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে প্রদান করেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। তাঁর ‘চল চল চল’ কে করা হয় বাংলাদেশের রণসংগীত। কবি নজরুলের ওপর সবার চেয়ে বেশি যে বাংলাদেশের মানুষেরই অধিকার আছে, সেকথা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে ভালো আর কে বুঝেছিলেন! ১৯৭২ সালের ২৫ মে ঢাকায় কবির বাসায় যাওয়ার সময় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে বের হয়ে “বিদ্রোহী” কবিতা আবৃত্তি করতে করতে পথ হেঁটেছেন বঙ্গবন্ধু।
বাঙালিদের যেমন তিনি তাঁর প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসতেন তেমনি শিল্প-সাহিত্যের প্রতি সবসময়ই ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। শিল্প-সাহিত্য যে একটি জাতির পরিচয় বহন করে, সেই সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন তিনি। রাজনীতি শিল্প-সাহিত্য থেকে বেশ দূরের বিষয় হলেও শিল্পানুরাগী বঙ্গবন্ধুর অনেক কাজে, কর্মে ও কথায় প্রকাশিত হতো শিল্প-সাহিত্যের ছোঁয়া। তাই তো তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের “মহাকবি”। বিশ্ব মিডিয়ায় পরিচিতি পেয়েছিলেন “পোয়েট অব পলিটিক্স” হিসেবে। আর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেশের শিল্প-সাহিত্যের প্রসারের ক্ষেত্রে তিনি রেখেছিলেন অনবদ্য ও অসাধারণ ভূমিকা।
লেখক : সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।
এইচআর/এমএস