পারস্য উপসাগরের দেশ কাতারে ‘ফ্রি ভিসা’ গিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। বিভিন্ন অপরাধে ২৪০ জন সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশি দেশটির জেলে বন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে ১৪৫ জন মাদক সংক্রান্ত অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত।
Advertisement
খণিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ দেশটিতে ফিফা বিশ্বকাপ উপলক্ষে অধিকাংশ উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ায় প্রবাসীরা বেকার হয়ে পড়ছে। এজন্য তারা অপরাধে জড়াচ্ছেন।
বুধবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৪র্থ বৈঠকে উত্থাপিত এক প্রতিবেদন এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নাইমা আফরোজ ইমা স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশিরা নানা ধরনের অপরাধ জড়িয়ে পড়ার ফলে কাতারে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
Advertisement
তথাকথিত ফ্রি ভিসার নামে প্রতারিত হচ্ছেন প্রবাসীরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাতারে ফ্রি ভিসার নামে অনেকেই যাচ্ছেন। শুধুমাত্র ভিসা বিক্রির জন্য কিছু ক্ষুদ্র কোম্পানি স্থাপন করা হয়। এসব কোম্পানি থেকে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা প্রদান করা হয়। এর প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত ভিসা কাতারে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মী রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে বিক্রি করা হয়।
পরবর্তীতে তা হাতবদল হয়। ওই বিষয়ে কাতারে লোক যাওয়ার পর কোনো চাকরি পায় না এবং কোম্পানিগুলো অফিস বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যায়। এ ধরনের অবৈধ ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশি কর্মীরা নিঃস্ব হয়ে যান এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়- কাতার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য শীর্ষস্থানীয় দেশ। ২০১৮ সালে ৭৬ হাজার ৫৬০ জন বাংলাদেশি কর্মী বৈধভাবে চাকরি নিয়ে কাতারে যান। বর্তমানে কাতারে বসবাসকারী বাংলাদেশি সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। ২০২২ সালে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের লক্ষ্যে কাতারে ব্যাপক উন্নয়ন কাজের সূচনা হয়। এসব উন্নয়ন কাজে কর্মরত বাংলাদেশির ৮০ শতাংশ অদক্ষ নির্মাণ শ্রমিক।
অনেকগুলো নির্মাণ প্রকল্প সমাপ্তির কারণে কাতারে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। এছাড়া ক্লিনিং ও মেইনটেনেন্স, হোটেল, সেলসম্যান, গাড়িচালক, টেইলারিং এবং কৃষি পেশায় বাংলাদেশিরা নিয়োজিত রয়েছেন। অল্পসংখ্যক চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, ব্যাংকার কাতারে কর্মরত রয়েছেন। কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
Advertisement
এছাড়া কাতার সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাতারি নাগরিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগের নীতি গ্রহণ করেছেন। ওই সব পেশায় বিদেশি নাগরিকদের চাকরি প্রাপ্তি সংকুচিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিককালে কাতারে আগমনকারী বাংলাদেশের মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই সেখানে স্বল্প বেতনের চাকরি করার ফলে ব্যয় কৃত অর্থ তুলতে না পেরে নানা অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। বর্তমানে কাতারে কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৪০ জন সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশি আটক রয়েছেন। এর মধ্যে ১৪৫ জন মাদক সংক্রান্ত অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত। কাতারে অবস্থিত ডির্পোটেশন সেন্টারে ২৮৬ জন পুরুষ এবং ১০ জন মহিলা আটক রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নাইমা আফরোজ ইমা বলেন, কাতারের জেলখানায় বন্দিদের মধ্যে ইয়াবা, মদ-গাঁজা বিক্রি ও সেবনকারীও রয়েছেন। তাদের মধ্যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি যেমন রয়েছেন, তেমনি ছয় মাস বা এক বছর মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিও আছেন।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ কাতারের মধ্যে বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী গঠিত কমিটির সবশেষ বৈঠকে ২০১৬ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী দুই বছর পরপর বৈঠক অনুষ্ঠান করার বিধান থাকলেও পঞ্চম বৈঠকটি এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। দুই পক্ষের সুবিধাজনক সমযে পঞ্চম বৈঠকটি দোহায় আয়োজন করা যেতে পারে।
কাতারের ভিশন অনুযায়ী বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাতার সরকার ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘কাতার জাতীয় ভিশন ২০৩০’ বিবেচনা করে সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এসব কর্মসংস্থানের মধ্যে রয়েছে; কৃষি ও প্রাণিসম্পদ বিভাগে কৃষি গবেষক, পশু চিকিৎসক।
তেল ও গ্যাস বিভাগে পেট্রোলিয়াম ও কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ার। বিদ্যুৎ প্রকৌশলী। অবকাঠামো নির্মাণ বিভাগে শ্রমিক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। প্রফেশনাল বিভাগে ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক।
এ ছাড়া সেবাখাত বিভাগে হোটেল বয়, ম্যানেজার, নিরাপত্তারক্ষী, গৃহকর্মী রয়েছেন। রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে আধাদক্ষ কর্মী্। কাতার এয়ারওয়েজ বিভাগে দক্ষ কর্মী। হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিচ্ছন্নকর্মী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বৃহস্পতিবার জাগো নিউজকে বলেন, খণিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ দেশটিতে আরো বাংলাদেশিদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই সম্ভাবনা নষ্ট করে দিচ্ছে কিছু অসাধু রিক্রুট এজেন্ট।
এদের তালিকা করে আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। ফ্রি ভিসার নামে সেখানে যাতে কেউ না যায় সে বিষয়ে প্রচারণার চালানোর জন্য বলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট কাজের চুক্তির মাধ্যমে ভিসা ইস্যু হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভিসার সব খরচ নিয়োগদানকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বহন করে। ফ্রি ভিসা বলে কিছু না থাকলেও মূলত কিছু অসাধু বাংলাদেশি স্থানীয়দের যোগসাজশে ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা পদ্ধতি চালু করেছে।
ফলে সাধারণ শ্রমিক তার সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে কাজ না পেয়ে অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েন। এমনি জেল জরিমানার ফাঁদে পড়েন। মূলত এ ভিসার প্রচলন আছে কাতার সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোয়।
প্রকৃতপক্ষে, প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা তাদের আত্মীয়-স্বজনকে তাদের কাছে নেয়ার স্বার্থে এসব ভিসার সহায়তা নেন। এ ধরনের ভিসা নিয়ে গিয়ে বিপদে পড়বেন জেনেও বিদেশে পাড়ি জমান বলে দাবি করেন প্রবাসীরা।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে প্রবাসীদের তালিকায় বাংলাদেশিরা সর্বোচ্চ। প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি রয়েছে দেশটিতে। নির্মাণ এবং আবাসন খাতে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশিদের বেশ সুনাম রয়েছে।
এইচএস/এমআরএম/জেআইএম