আলতাফ পারভেজ। লেখক ও গবেষক। গবেষণা করছেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। লিখছেন এ অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ নিয়েও। কাশ্মীর পরিস্থিতি এবং আসামের এনআরসি (জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন) ইস্যু নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। নির্মোহ আলোচনা করেন দুটি বিষয়েই।
Advertisement
তিনি বলেন, আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদ নীতির প্রতিফলন ঘটছে আসাম আর কাশ্মীরে। বিজেপি হচ্ছে আরএসএস’র অঙ্গ সংগঠন। মূলত মোদি সরকার হচ্ছে আরএসএস’র সরকার। তারা হিন্দুত্ববাদকে সামনে এনে জঙ্গি বা জাতীয়তাবাদে রূপ দিয়েছে।
কাশ্মীর প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি বলেন, কাশ্মীরে হত্যা, গণহত্যা হবে। কিন্তু কে জিতবে, তা বলা যাবে না। হয়তো আমরাও এ যুদ্ধের শেষ দেখে যেতে পারব না। তবে কাশ্মীর যুদ্ধ থেকে ফিরে আসতে পারবে না ভারতও।
এ গবেষকের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে গুরুত্ব পায় রোহিঙ্গা ইস্যুও। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
Advertisement
জাগো নিউজ : কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। আসামের এনআরসি (জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন) নিয়ে বিপাকে বাঙালি মুসলমনারা। আসাম পরিস্থিতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
আলতাফ পারভেজ : কাশ্মীরে একধরনের প্রতিরোধ আছে। আসামে তাও নেই। রাষ্ট্র চাইছে আর লাখ লাখ মানুষকে নাগরিকহীন করে দিচ্ছে। যাদের অধিকাংশই বাঙালি মুসলমান। তারা অত্যন্ত গরিব। নদীভাঙা মানুষ। নদীর চরেই অনেকের বসবাস। নদীভাঙা গরিব মানুষের কাছে কাগজপত্র থাকে না। তাদের কাছে পাসপোর্ট, জমির দলিল, পোস্ট অফিসের অ্যাকাউন্ট নম্বর চাওয়া হচ্ছে। তারা কই পাবে এসব কাগজ?
আসামের মোট জনসংখ্যা তিন কোটি। সেখানে যদি অন্তত ২০ লাখ মানুষও নাগরিকত্ব হারায় পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের সঙ্গে মেলানো হচ্ছে নাগরিকত্বহীন এসব মানুষকে। বাংলাদেশের জন্য সংকটটা কী?
Advertisement
আলতাফ পারভেজ : ভারতের মানুষ মনে করছে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। এটি সত্যি নয়। নাগরিকত্বহারা আসামের বাঙালিরা বাংলাদেশের নয়। ১৯০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ, ভারত ও পাকিস্তানের তৈরি শুমারি থেকে বলতে পারব, আসামের এসব মানুষ যে বাংলাদেশ থেকে গেছে তার পরিসংখ্যানগত কোনো ভিত্তি নেই। এটি একটি প্রচার। বছরের পর বছর ধরে এ প্রচার হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশেও এ নিয়ে একধরনের মিথ তৈরি হয়েছে।
ভারতের শুমারি দলিলও এ প্রচার সমর্থন করে না। উদাহরণ দিয়ে বলি, বাংলাদেশ থেকে মানুষ আসামে গেলে সাধারণত সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে যাবে। ভারতের খসড়া এনআরসি-তে দেখা গেছে, সেখানে ৯৫ ভাগ মানুষেরই নাগরিকত্ব আছে। অথচ অবৈধ নাগরিকদের বেশির ভাগই উল্লেখ করা হয়েছে উজানের জেলাগুলোতে। চীন-মিয়ানমার সংলগ্ন জেলাগুলোতে। এটি বাস্তবসম্মত হতে পারে না। এর বাইরেও আমি পরিসংখ্যানগত প্রমাণ দিতে পারব যে, তারা বাংলাদেশ থেকে যায়নি।
জাগো নিউজ : এ প্রচার কেন গুরুত্ব পেল?
আলতাফ পারভেজ : আসাম একটি স্বাধীন দেশ ছিল। ব্রিটিশরা বার্মার (মিয়ানমার) কাছ থেকে আসামকে নিয়েছিল। আবার দিয়ে গেছে ভারতের কাছে। যেমন কাশ্মীরকে রণজিৎ শাহ্র কাছ থেকে নিয়ে জম্মুর রাজার কাছে দিয়ে গিয়েছিল। আর জম্মুর রাজা দিয়েছে ভারতকে।
এ কারণে আসামের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অন্তর্জ্বালা ছিল। তারা মনে করেন আমাদের অর্থ, খনিজ সম্পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নয়াদিল্লি। ষাটের দশক থেকে আশির দশকে এ জ্বালা নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। আসামের আলোচিত স্লোগান হচ্ছে, জান দেব তেল দেব না। এ স্লোগানের ওপর ভর করেই উলফা হয়েছে।
সমস্ত ইস্যু ঘুরিয়ে এখন আসামে অবৈধ বাঙালি-মুসলিম ইস্যু বানানো হয়েছে। যাতে অর্থনৈতিক বঞ্চনা, স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায়। এনআরসি রাজনীতিতে চাপা পড়ে গেছে উলফার মতো সংগঠনও। তারাও এখন এনআরসি নিয়ে ব্যস্ত।
জাগো নিউজ : বিজেপি সরকারের এনআরসি নীতি থেকেও আসাম সংকটের নতুন ইস্যু হতে পারে কি-না?
আলতাফ পারভেজ : নতুন ইস্যু তৈরির সুযোগ আছে বলে আপাতত মনে করছি না। আসামে এখন বিজেপি সরকার। কেন্দ্রেও বিজেপি সরকার। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই আসাম সরকার এখন বাস্তবায়ন করবে। এমন বিভাজন করে রাখতে না পারলে আসামে বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। সুতরাং কাশ্মীরের মতো আসামেও হাহাকার ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা চাপ বাড়ছেই। আসামের এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশ চাপ অনুভব করছে কি-না?
আলতাফ পারভেজ : বাংলাদেশের মানুষ হয়তো আসামের রাষ্ট্রহীন মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় আসেনি। কারণ ভারত এখনও বলেনি যে, আসামের অবৈধ নাগরিকদের বাংলাদেশকে নিতে হবে। আসাম সরকারও বলেনি।
কিন্তু ভবিষ্যতে যে বলবে না, তা-তো বলা যাবে না। কারণ ভারতের গণমাধ্যম, গবেষণা, সাহিত্যে সবসময়ই বলা হয়, আসামের এসব মানুষ বাংলাদেশি। ভবিষ্যৎ উদ্বেগ বাড়াবে বাংলাদেশের।
জাগো নিউজ : কাশ্মীর, আসাম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নীরব। এ নীরবতার ব্যাখ্যা কী?
আলতাফ পারভেজ : এটি বাংলাদেশের অবস্থান। সরকার এ মুহূর্তে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে যাবে না। যদিও বাংলাদেশের জনগণ ভারত প্রসঙ্গে নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।
বাংলাদেশ আসলে ভারতের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র শক্তি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে হাবুডুবু খাচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীনের সমর্থন দরকার। এ কারণেও হয়তো বাংলাদেশ সরকার ভারতের ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চায় না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের সমর্থন দরকার পড়তে পারে।
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আটকে গেল। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আলতাফ পারভেজ : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আপাতত হবে না। এটি আমি আগেও বলেছি।
জাগো নিউজ : ভবিষ্যৎ কী?
আলতাফ পারভেজ : রোহিঙ্গারা রাজি থাকলেও প্রত্যাবাসন আপাতত সম্ভব নয়। কারণ রাখাইন রাজ্যজুড়ে যুদ্ধাবস্থা চলছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলো আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার আর্মির যুদ্ধ চলছে। রোহিঙ্গা আলোচনায় এটি অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
জাগো নিউজ : আরাকান আর্মিরা ফের যুদ্ধাবস্থায়...
আলতাফ পারভেজ : এটি-ই অবাক করেছে। এই প্রথম আরাকান আর্মির সমর্থনে সেন্ট্রাল বার্মার দুটি সংগঠন সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে। মান্দাল ও শান রাজ্যে আমরা হামলা করতে দেখলাম।
আমি মনে করি, আরাকান আর্মির শক্তি অনেক উচ্চস্তরে চলে গেছে। বার্মার এ ধরনের গেরিলা সংগঠনের ওপর চীনের সমর্থন আছে বলে মনে করা হতো। অথচ চীন এবার ওই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। তার মানে গেরিলারা চীনের কথাও শুনছে না।
জাগো নিউজ : তাহলে মিয়ানমারের সংকট আরও বাড়ছে?
আলতাফ পারভেজ : আগের অবস্থায় না ফিরলেও যুদ্ধাবস্থা বেড়ে গেছে, তা যে কেউ বলতে পারবে। আরাকান আর্মি আরও শক্তিশালী হবে।
জাগো নিউজ : চীন যদি নিন্দা জানায়, তাহলে মিয়ানমারের গেরিলাদের শক্তির উৎস কী?
আলতাফ পারভেজ : যেকোনো সংগঠনকে টিকে থাকতে হলে তাকে কিছু অর্জন দেখাতে হবে। আরাকানের রাজনীতিকরা মনে করেন, তারা স্বাধীন ছিল। ব্রিটিশরা বার্মার কাছে দিয়ে গেছে। দিনশেষে রাখাইনদের তো কিছু পাইয়ে দিতে হবে এসব রাজনীতিকদের।
অং সান সু চি ক্ষমতায় এসেছেন চার বছর। সু চির কাছ থেকে শান স্টেটের রাজনীতিকদের বাড়তি সুবিধা নেয়ার কথা ছিল। পারেননি। এ কারণেই যুদ্ধাবস্থা দেখাতে হচ্ছে; এ কারণে চীনের নিয়ন্ত্রণকেও অমান্য করতে হচ্ছে।
চীন বার্মায় এখন বাণিজ্যের বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। সে বাণিজ্যে সবসময় বার্মার মানুষের স্বার্থ টিকে থাকবে, তার কোনো মানে নেই।
জাগো নিউজ : আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কোনো বোঝাপড়া হতে পারে কি-না?
আলতাফ পারভেজ : আগে তো রাখাইনদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক ছিল বিপরীতমুখী। আরাকান আর্মি এখন তাদের অবস্থান পাল্টিয়েছে। আরাকান আর্মি মনে করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তবে রোহিঙ্গাদের ন্যায্য মানবাধিকার দিয়ে আরাকানে রাখা হোক। এটি তাদের আদর্শিক পরিবর্তন।
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ এখন কী করতে পারে?
আলতাফ পারভেজ : রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ভরসা করেছে চীন ও ভারতের ওপর। কিন্তু চীন ও ভারত সমাধান করতে পারছে না। এ কারণেই বাংলাদেশকে ফের ভাবতে হবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক মহলকে আরও বোঝাতে হবে।
জাগো নিউজ : সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কী বার্তা দেবেন?
আলতাফ পারভেজ : উদ্বেগ বাড়বে। সংঘাত ছড়াবে। আন্তঃদেশীয় সম্পর্কগুলো খারাপ হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশ ঘটবে চরমে। অবিশ্বাস তো তৈরি হয়েই গেছে।
সবচেয়ে বিপদের কথা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সমস্যা সমাধানে বসার কোনো স্পেস রাখছে না। পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয়, তবুও সমঝোতার কোনো লক্ষণ নাই। এএসএস/এমএআর/এমএস