প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান। সদ্যজাত টেস্ট শিশু। মাত্র তিনটি টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটি দল। তাদের সাথে ১৯ বছরের টেস্ট যুবা বালাদেশের খেলা নিজ মাটিতে; চট্টগামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে।
Advertisement
টি-টোয়েন্টি ফরমাটে যতই মারদাঙ্গা দল মনে হোক না কেন, ওয়ানডেতেও মাঝে মধ্যে যেমন ডাকাবুকো হয়ে দেখা দিক না কেন, আসল সত্য হলো টেস্টে আফগানরা এক দুর্বল, আনকোরা এবং নবীন দল।
অভিজ্ঞতা, শক্তি-সামর্থ্য এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি মেলানোয় বাংলাদেশের চেয়ে যোজন-যোজন পিছিয়ে তারা। খুব স্বাভাবিকভাবেই আফগানদের সাথে টেস্ট নিয়ে বাংলাদেশ ভক্ত ও সমর্থকদের উৎসাহ-আগ্রহও খুব কম।
তবে একটা চিন্তা আছে। তাহলো দেশের মাটিতে টেস্টে বাংলাদেশের সব সময়ের মূল শক্তি স্পিন বোলিং। হোক তা প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকা কিংবা ভারত- বাংলাদেশের টেস্ট কম্বিনেশন প্রায় সব সময়ই এক। অন্তত তিন স্পিনার নিয়ে মাঠে নামা।
Advertisement
ঘরের মাঠে সব সময় এই তিন স্পিনার ফর্মুলাই সবচেয়ে কার্যকর। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার মত দলকে হারানো সম্ভব হয়েছে সাকিব, তাইজুল আর মিরাজে গড়া ওই স্পিন আক্রমণ দিয়েই। খুব স্বাভাাবিকভাবে আফগানিস্তানের সাথেও নিশ্চয়ই ওই তিন স্পিনার ফর্মুলাই বহাল থাকবে।
হয়তো দেখা যাবে ৫ সেপ্টেম্বর জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ওই তিন স্পিনার নিয়েই গুলবাদিন নাইব, রশিদ খান ও মোহাম্মদ নবিদের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নামছে সাকিবের দল।
তা না হয় নামলো; কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। আফগানদেরও তো মূল শক্তি স্পিন বোলিং। তাদেরও আছে রশিদ খানের মত সময়ের অন্যতম বিশ্ব সেরা লেগস্পিনার। মোহাম্মদ নবির মত টাইট লাইন ও লেন্থের অফব্রেক আর জহির খান নামের এক উঠতি বাঁ-হাতি স্পিনার।
কাজেই উইকেট যদি শতভাগ স্পিন সহায়ক থাকে, বল যদি প্রথম দিন থেকেই টার্ন করতে থাকে- তাহলে কি হবে? ধরা যাক সাকিব, তাইজুল আর মিরাজের বিষাক্ত স্পিন ঘূর্নির জালে ধরা পড়লো আফগান ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু রশিদ খান, নবি আর জহির খান কিংবা রহমত শাহরা কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবেন? উইকেটে টার্ন থাকলে তাদের বলওতো ঘুরবে। তখন কি হবে? সেটাও তো সামলাতে হবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের?
Advertisement
অর্থাৎ শতভাগ স্পিন সহায়ক উইকেটে খেলা হলে বাংলাদেশের স্পিনারদের পাশাপাশি আফগান স্পিনারদেরও জেঁকে বসার সম্ভাবনা থাকবে। আর এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, আফগান স্পিন খুব বাজে ও অকার্যকর।
রশিদ খানের সামর্থ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। নিষ্প্রাণ মরা পিচেও তার বল লাটিমের মত ঘোরে। যে কোন ফরম্যাটে বিশ্বের সব বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানও তাকে খেলতে প্রচন্ড শীতেও ঘামতে শুরু করে। আর উইকেটে টার্ন বেশি থাকলে তখন তাকে খেলা হবে আরও কঠিন। নবি-জহির খান কিংবা রহমত শাহরাও তখন কম যাবেন না ।
কাজেই টিম আফগানিস্তান নয়, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ‘উইকেট’ই এখন টাইগারদের বড় প্রতিপক্ষ! বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট ওই উইকেট নিয়েই গভীর চিন্তায় আছে। তাদের মনে খানিক সংশয় এবং দ্বিধা।
এর মধ্যে কেউ কেউ আবার ধরে নিয়েছেন, আফগান স্পিনাররা যাতে জেঁকে বসতে না পারে, তাই বাংলাদেশ ঘাসের সবুজ পিচে খেলতে নামবে। বলার অপেক্ষা রাখে না জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামের উইকেটের ওপরে এখনো সবুজ ঘাসের স্তর আছে। তা দেখে আবার কেউ কেউ ‘গ্রাসি’ উইকেট, ঘাসের পিচ ভাবতে শুরু করেছেন।
কিন্তু একবারও ভাবছেন না ঘাসের পিচ হোক আর সবুজ কার্পেটে মোড়ানো টার্ফই হোক- বাংলাদেশের কি সেই পিচের এডভান্টেজ নেয়ার মত কোয়ালিটি ফাস্ট বোলার বা কুশলী পেসার আছে?
উইকেটে যতই ঘাস থাকুক না কেন, বল ফেলতে হবে জায়গামত। বলে কিছু কারুকাজ থাকতে হবে। ‘ন্যাচারাল ম্যুভমেন্ট’ দরকার। ভাল লাইন-লেন্থ প্রথম কথা। সাথে টেস্টে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল করার মত বাড়তি গতি, সুইং আর বিপজ্জনক বাউন্সও জরুরি।
বাংলাদেশের একজন পেসারের কি ওই সহজাত গুনাবলি আছে? শফিউল, রুবেল, মোস্তাফিজ, আবু জায়েদ রাহি, আবু হায়দার রনি, যদি সুযোগ পান তাহলে তাসকিন- সাকুল্যে এই ভরসা; কিন্তু তাদের সামর্থ্যও তো সীমিত। ওপরে যা যা বলা হলো তাদের ভিতরে কি আছে ওই সব অত্যাবশ্যকীয় গুণাবলি?
সবুজ উইকেটে খেলা হলে বরং বাংলাদেশেরই সমস্যা হতে পারে। প্রথম কথা ওই ধরনের উইকেটে সুবিধা নিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের বেকায়দায় ফেলতে আর ঘায়েল করতে নিজেদের যে কোয়ালিটি লাগে, নির্জলা সত্য বাংলাদেশের পেসারদের তার ঘাটতি আছে।
তাই সবুজ টার্ফে আফগানদের কাবু করার প্রশ্নই আসে না। উল্টো উইকেটে ঘাস বেশি থাকলে বরং নিজেদের সমস্যা হতে পারে। তামিম নেই। উইকেটে ঘাস থাকলে বরং আফগান পেসারদের বাড়তি সুবিধা হবে। তারা গড়পড়তা বাড়তি গতিতে বল করেন। বাউন্স আর ম্যুভমেটেও বাংলাদেশের পেসারদের চেয়ে বেশি। কাজেই উইকেটে বাড়তি ঘাস থাকার অর্থ, উল্টো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের চাপে পড়ার শঙ্কা। কাজেই সবুজ পিচে খেলার প্রশ্নই আসে না।
তাহলে কেমন উইকেটে খেলা হবে? কি ধরনের পিচ চাচ্ছে স্বাগতিকরা? এটা খারাপ বা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার কিছু নেই। টেস্টে সেই প্রায় ১৯৫০ দশকের পর থেকেই সব দেশ নিজেদের বোলিং ও ব্যাটিং শক্তির আলোকে উইকেট তৈরি করে। ভারতে স্পিন ট্র্যাক, শ্রীলঙ্কায় স্লো, পাকিস্তানের ফাস্ট ও স্পিনের মিশেল, দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ায় ফাস্ট-বাউন্সি আর ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডে ন্যাচারাল ম্যুভমেন্টের উইকেটেই টেস্ট হয়।
বাংলাদেশ বরাবরই চট্টগ্রামে তুলনামূলক ব্যাটিং সহায়ক পিচেই খেলে এসেছে। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের টেস্ট উইকেট মূলতঃ ব্যাটিং সহায়ক। বল আসে ব্যাটে। বাউন্সও মোটামুটি। আর সময় গড়ানোর সাথে সাথে খানিক টার্ন নেয়।
সে কারণেই ওপরের স্তরে ঘাস থাকে। যেটা মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে। ওই ঘাস নিয়ে চিন্তার বা লাফালাফির কিছু নেই। সেটা স্বাগতিক দলের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করবে, যে কতটা থাকবে?
আইসিসির বেঁধে দেয়া নিয়ম ও নীতি অনুযায়ী কিউরেটর উইকেট সম্পর্কে আগাম কোন কথা মিডিয়ায় বলতে পারেন না। চট্টগ্রামের হেড কিউরেটর জাহিদ রেজা বাবুরও তাই। জাগো নিউজের সাথে মঙ্গলবার রাতে মুঠোফোনে অনেক কথা বললেও উইকেটের আচরণ, গতি-প্রকৃতি নিয়ে একটি কথাও বলেননি।
কিন্তু ভিতরের খবর, এখন পর্যন্ত ঢাকা থেকে কোচ, নির্বাচক এবং অধিনায়ক বা ক্রিকেট অপারেশন্স কিংবা বোর্ডের কোন নির্দেশিকা যায়নি চট্টগ্রামে। কাল রাত অবধি বলা হয়নি, কেমন পিচ হবে বা বাংলাদেশ দল কি ধরনের উইকেট চাচ্ছে?
ভাবা হচ্ছে, এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ১-২ আগস্টের দুই দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ দেখে তারপর উইকেটের চরিত্র ও আচরণ এবং গতি প্রকৃতি ঠিক করার কথা ভাবছেন স্বাগতিক টিম ম্যানেজমেন্ট। হয়ত তখনই বলা হবে ঠিক কেমন পিচ চাচ্ছেন সাকিব?
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের পিচ বরাবর শুরুতে এক-দুই বা তিনদিন কিছুটা ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি থাকে। তারপর যত সময় গড়ায় তত স্লো হতে থাকে। বল একটু-আধটু টার্নও করে।
একটি ছোট্ট পরিসংখ্যানেই মিলবে সে সত্যের দেখা। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত টেস্টে ৯ বার ৫০০ থেকে ৬০০ রান করেছে। তার তিনটিই চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। আর স্পিন ট্রাস্প কার্ড সাকিবের ইনিংস সেরা বোলিং স্পেলটিও এই মাঠেই (২৫.৫-৭-৩৬-৭), নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর।
সেটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে উপযোগি ও সহায়ক পিচ। অতীতে সে ধরনের পিচেই এসেছে সাফল্য। তাতেই মুমিনুল, মুশফিক-সাকিবরা লম্বা ইনিংস খেলতে পারবেন। আবার পরে সাকিব, তাইজুল ও মিরাজরা বলও ঘোরাতে পারবেন। বাড়তি বা নতুন কিছু করতে যাওয়া মানে তাই ‘অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া।’ লাগতেও পারে। নাও লাগতে পারে। কি বলেন, ঠিক না?
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম