জাতীয়

ঋণের বোঝা কমাতে ‘পাঠাও’ চালাতেন মিলন

নিজের প্রাইভেটকার ভাড়ায় চালিয়ে সংসার চালাতেন মিলন। সন্তানের অসুস্থতা, সাংসারিক টানাপোড়েন আর আড়াই লাখ টাকা ঋণের কারণে বাধ্য হয়ে প্রাইভেটকার বিক্রি করে দেন। গাড়ি বিক্রি করে ডায়াং ১৫০ সিসির একটি মোটরসাইকেল কেনেন। রাইড শেয়ারিং অ্যাপস পাঠাও চালিয়ে সপ্তাহে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকার ঋণ শোধ করতেন।

Advertisement

প্রতিদিনের মতো রোববার রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন মিলন। রাত সোয়া ২টার দিকে যাত্রী নিয়ে মালিবাগ থেকে শান্তিনগরের দিকে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা তার গলা কেটে মোটরসাইকেল ছিনতাই করে নিয়ে যায়। পরে কাটা গলা নিজেই হাতে চেপে ধরে উড়াল সড়কে দৌড়াতে থাকেন। দুই পথচারীর সহযোগিতায় মিলনকে নেয়া হয় শান্তিনগর মোড়ে টহল পুলিশের কাছে।

সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল ও পরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন তাকে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার মিরপুরে তার দাফন সম্পন্ন করে পরিবার।

এ ঘটনায় শাহজাহানপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন নিহত মিলনের স্ত্রী শিল্পী বেগম। মামলার এজাহারে তিনি অভিযোগ করেন, মিলনের সঙ্গে থাকা যাত্রীই ধারালো অ্যান্টি কাটারে হত্যা করে মোটরসাইকেল, মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় মোটরসাইকেল উদ্ধারসহ দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেফতারে অভিযানে নেমেছে পুলিশ।

Advertisement

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মিলন মিরপুরের গুদারাঘাটে পরিবার নিয়ে থাকতেন। তার ১০ বছরের একটি ছেলে ও ৫ বছরের একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে।

শাহজাহানপুর থানায় কথা হয় নিহত মিলনের বন্ধু মো. হিমেলের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, পুলিশের মাধ্যমে আমাকে ঘটনার খবর জানায় মিলন। খবর পেয়ে আমি ওর পরিবার নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। ওর রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে বেগ পাচ্ছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু রক্তের গ্রুপ না জানার কারণে দ্রুত রক্তের বন্দোবস্তও করা যাচ্ছিল না।

তিনি বলেন, অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে ডাক্তার ও নার্সরা জানান আগে রক্ত লাগবে তারপর চিকিৎসা। বেডে নেয়ার পর মিলনের মাথা ছিল আমার হাতেই। ওর বাবা আসার পর মিলন ইশারায় বাবার কাছে হাতজোর করে ক্ষমা চায়। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে মিলন। কিছুক্ষণ পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

একই এলাকার ৭-৮ বছরের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম। নিজের প্রাইভেটকার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালায় সিরাজ। কোনো ট্রিপ নিয়ে যাওয়ার আগে সব সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলতেন মিলন ও সিরাজ।

Advertisement

ওইদিন রাতে দুজনেরই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাওয়ার কথা ছিল। সবশেষ রাত ২টা ১২ মিনিটে মিলনের সঙ্গে কথা হয় সিরাজের। এর ২৩ মিনিট পর সিরাজ জানতে পারেন যে মিলনের গলা কেটে তার মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ওকে দেখে কখনও বোঝার উপায় নেই অর্থকষ্টে আছে। সংসার সামলাতে প্রতিদিন পাঠাও চালানো শুরু করে। ওর কষ্টগুলো আমি জানতাম। ঈদের পরে ওর ঋণের চাপ বেড়ে যাওয়ায় রাতদিন পাঠাও চালাতো।

শাহজাহানপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আতিকুর রহমান বলেন, রাইড শেয়ারিংয়ে যাত্রী নিলেও ওই রাতে মিলন অ্যাপস ব্যবহার করেননি। তিনি পাঠাও ও সহজ রাইডের তথ্যানুযায়ী সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট অ্যাপস ব্যবহার করেন। তবে আমরা উবারের তথ্য এখনও পাইনি।

এসআই আতিক বলেন, ‘মিলন যথাসম্ভব চুক্তিতে যাত্রী নিয়ে শান্তিনগরের দিকে যাচ্ছিলেন। যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী মিলনের গলায় অ্যান্টি কাটারে আঘাত করে। গলায় তিন ইঞ্চি গভীর ক্ষত হয়। শিরা কেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মিলন মারা যান।

মতিঝিল বিভাগের সবুজবাগ জোনের সহকারী কমিশনার মো. রাশেদ হাসান বলেন, ‘আমরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। ছিনতাই হওয়া মোটরসাইকেল ও মোবাইলফোন উদ্ধারে অভিযানও চলছে। আশা করছি, শিগগিরই খুনিদের আটক করতে পারব।’

শাহজাহানপুর থানার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজে ফ্লাইওভারের দ্বিতীয় তলা পরিষ্কার কাভার করলেও তৃতীয় তলা পরিষ্কার নয়। তবে আমরা সিসিটিভি ক্যামেরায় ঘটনার কিছু পরই সন্দেহভাজন দুজনকে মোটরসাইকেল চালিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যেতে দেখেছি। সম্ভাব্য দুজনকে আমরা সাসপেক্ট করেছি। তাদের অবস্থানও নিশ্চিত হয়েছি। শতভাগ নিশ্চিত হওয়া মাত্র তাদের গ্রেফতার করা হবে।

জেইউ/জেএইচ/জেআইএম