মতামত

সরকারকে ‘একা’ করে দিচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু

মিয়ানমার রাষ্ট্রের নিপীড়ন আর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ আশ্রয় গ্রহণ করা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আবারও আলোচনায় ওঠে এসেছে কারণ তাদের এদেশে আশ্রয়গ্রহণের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে যে সমাবেশ তারা করেছে সেখান থেকে তারা ঘোষণা দিয়েছে যে, মিয়ানমার তাদেরকে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তারা সে দেশে ফিরে যাবে না।

Advertisement

এই শর্তগুলো অনেক দিন ধরেই আলোচনায় থাকলেও এই প্রথম তারা লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ ঘটিয়ে এই বক্তব্য বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহলকে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিলো। এর আগে একাধিকবার মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের মধ্যে থেকে বাছাই করে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চাইলেও তাদের এক কথা “আঁরা ন যাইয়ুম”।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে স্পষ্টতঃই মতভিন্নতা রয়েছে কিন্তু রোহিঙ্গা সমাবেশের ছবি দেখে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা আসলে একটি ভয়ঙ্কর দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। অচিরেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা না নেয় তাহলে বাংলাদেশের নিজস্ব ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

দু’বছর আগে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে যখন দলে দলে রোহিঙ্গারা এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে তখনই এ প্রশ্নটি তুলেছিলাম যে, এর আগে যে সকল রোহিঙ্গা এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকেই যখন ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার আগ্রহ দেখায়নি, নতুন করে যারা আসছে তাদেরকে দেশটি আর কখনওই ফিরিয়ে নেবে বলে মনে করার কোনোই কারণ নেই।

Advertisement

এমনিতেই বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ রাষ্ট্র, এখানেও রয়েছে ভয়ঙ্কর অসামঞ্জস্য আয় ও জীবন-যাপনে, তার ওপর যদি ১০ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব বাংলাদেশকে নিতে হয় তাহলে তা হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একটি বিশাল চাপ। সে চাপ সামাল দেয়া গেলেও যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে বাংলাদেশের সামাজিক বিপর্যয় তৈরি হবে তা সামাল দেওয়াও বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু সেই সময় সরকারের হাতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার বিকল্প কোনো পথও খোলা ছিল কিনা সে প্রশ্নটিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠী যখন ১৯৭১ সালে প্রতিবেশি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তখন দেশটি আমাদেরকে কেবল আশ্রয়ই দেয়নি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সহযোগিতা করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তাও দিয়েছিল।

বাংলাদেশের সামনে সেরকমই একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল মানবিকতা প্রদর্শনের কিংবা ১৯৭১-এর মানবতাবোধকে ফিরিয়ে দেওয়ার। শেখ হাসিনার সরকারের সামনে সে সময় একমাত্র বিকল্প ছিল মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, বাংলাদেশের মতো উঠতি অর্থনীতির দেশের জন্য তা হতো একেবারেই আত্মহত্যার মতো ঘটনা। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট উস্কানি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি সত্যিকার মানবিক রাষ্ট্রের মতো কোনো উত্তেজনা প্রদর্শন করেনি। এর মধ্যে দেশের ভেতরকার ধর্মবাদী রাজনৈতিক দলগুলিও বার বার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে চাপ দিতে শুরু করেছিল। বলাই বাহুল্য রোহিঙ্গারা যদি ধর্মপরিচয়ে মুসলিম না হতো তাহলে তাদেরকে এদেশে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কতোখানি সাড়া পাওয়া যেতে সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশকে যথেষ্ট চাপের মধ্যে রেখেছিল রোহিঙ্গা প্রশ্নে।

শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই সে সময় বলেছিলেন যে, তার সরকার যদি ১৬ কোটি মানুষের মুখে অন্ন জোগাতে সমর্থ হয়ে থাকে তাহলে আরও ১০/১২ লাখের মুখে অন্ন জোগাতে পারবেন, নিতান্তই মানবিক কারণে যে এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। নিন্দুকেরা অবশ্য বলে থাকেন বা এখনও বলে চলেছেন যে, কেবলমাত্র নোবেল পুরস্কারের লোভেই শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা এরপর যতোগুলো আন্তর্জাতিক ফোরামে গিয়েছেন প্রত্যেকটিতে গিয়েই তিনি প্রতিবার একটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, তাহলো মিয়ানমারকে অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে এবং সে জন্য যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারকে চাপ দেয়।

জাতিসংঘের মতো সুপার-পাওয়ার সংস্থায় গিয়েও শেখ হাসিনা এদেরকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টির ওপর জোর দেন। কিন্তু জাতিসংঘের মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আজও পর্যন্ত মিয়ানমারকে যথেষ্ট কড়া করে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদের মুরুব্বি রাষ্ট্রগুলো কথায় কথায় একাধিক দেশের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে, বাণিজ্যিক ভাবে বয়কট করে কিন্তু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ এখনও পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ এরকমটাই হতে পারে যে, মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর হাতে গণহত্যার শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত নাগরিকের ধর্মবিশ্বাস ইসলাম এবং তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত মিয়ানমার আসলে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য উন্মুক্ত বাণিজ্যের কাঙ্খিত বাজার।

Advertisement

চীন ও রাশিয়ার মতো পুরোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রদ্বয়ও মিয়ানমারের এহেন অমানবিক কাণ্ডের বিরুদ্ধে যেতে নারাজ। বরং বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক নৌ-রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের যে কৌশল নতুন মিয়ানমারে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরোন বা থেরেসা মে’র একাধিকবার সফরের মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল তা আজও বলবৎ রয়েছে রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের দৃশ্যমান কোনো চাপ প্রয়োগে অংশ না নেয়ায়।

অপরদিকে চীনের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক টানাপড়েনের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়া দু’পক্ষের সঙ্গেই আছে এমন নীতিতে অটল থাকায় মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা বিষয়ে কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগতো দূরের কথা এ বিষয়টি নিয়ে রাশিয়া কোনো প্রকার আগ্রহই দেখায়নি। আর প্রতিবেশি ভারত যে কিনা ১৯৭১ সালে কোটি খানেক বাঙালি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে প্রশংসিত হয়েছিল সেই ভারত তার আঞ্চলিক ‘দাদাগিরি’কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চীন-কেন্দ্রিক বাণিজ্যযুদ্ধে জয়লাভের জন্যই কাজ করে চলেছে।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুমুখী করাতের মতো। দেশের ভেতরেও যে করাত গলা কাটবে অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির তেমনই দেশের বাইরেও বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক করে তুলছে। প্রশ্ন হলো, এর শেষটায় কি আছে সেটা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? উত্তর হলো না, পাচ্ছি না।

দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক ভাবে রোহিঙ্গা ইস্যু যখন চরম আশঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে ঠিক তখনই সরকারের অজ্ঞাতে (পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাতে) কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সমাবেশ আয়োজন নতুন যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তাহলো, যদি অতি দ্রুত এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার ফিরিয়ে না নেয় তাহলে তারা এদেশে কী ভাবে থাকবে? বাংলাদেশ তাদেরকে কোন্ মর্যাদায় রাখবে? বছরের পর বছর তাদেরকে ভরণপোষণ দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কিনা? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই বা আসলে কী চাইছে?

শেষ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে, জাতিসংঘসহ ছোট-বড় সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে ওকালতি করছে। তারা এটা কেন করছে সে প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘ, তবে মূল কথা হচ্ছে এটাই তাদের কাজ বা রুটিরুজি। বিশাল রোহিঙ্গা সমাবেশ ঘটানোয় দেশি ও বিদেশি এনজিওদের কোনো প্রকার হাত ছিল না তা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে জানান দেওয়ার লক্ষ্যেই হোক কিংবা বাংলাদেশ সরকারকে রোহিঙ্গা-শক্তি সম্পর্কে আরো অবহিত করার উদ্দেশ্যেই হোক এই বিরাট আয়োজনের পেছনে এই এনজিওদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। নাহলে এতো সুসংগঠিত ও শান্তিপূর্ণ আয়োজন সম্ভবপর হতো না, পৃথিবীর কোনো দেশেই শরণার্থীদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি।

সুতরাং নিজেদের কর্মযজ্ঞ টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও দেশি ও বিদেশি এনজিওকূল রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতি। এক্ষেত্রে স্পষ্টতই সরকার একা হয়ে পড়েছে বলে প্রতীয়মান। তার মানে এই মুহূর্তে অবিলম্বে সরকারকে রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি কঠোর ও সুষ্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করতে হবে। নাহলে যে সমাবেশ তারা করে দেখিয়ে সকল পক্ষকে একটি বার্তা দিয়েছে তা কেবল বার্তাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভুলে গেলে চলবে না যে, তাদের আসলে হারানোর কিছুই নেই, সবকিছুই তাদের জন্য পাওনা ছাড়া কিছু নয়।

ঢাকা ২৭ আগস্ট, মঙ্গলবার ২০১৯

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/পিআর