একাত্তরে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বাঁশবাড়িয়ার আব্দুস সামাদ ওরফে ফিরোজ খাঁ ওরফে মুসার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
Advertisement
তার বিরুদ্ধে আনা চার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেন।
এটি হলো ট্রাইব্যুনালের ৩৯তম রায়। ১৭৪ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়েন কনিষ্ঠ বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও বাকিটুকু পড়েন মো. আমির হোসেন এবং রায়ের সর্বশেষ অংশ পড়েন চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম।
এ সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানিতে ছিলেন প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা ও প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান।
Advertisement
রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামি যে অপরাধ করেছে, সন্দেহাতীতভাবে সেসব অপরাধ আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। রায়ে চারটি অভিযোগেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।’
অন্যদিকে, আসমিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাঁওতাল পল্লীর লোকদের সঙ্গে আসামির বাবার জমি-সংক্রান্ত বিরোধ ছিল। ১৯৬৪ সালে জমি বিনিময় করে সাঁওতালরা এসেছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীনের বছরে এসে সাঁওতালরা বিনিময়কৃত ৫০ একর জমি ফেরত চাইলে আসামি, আসামির বাবা এবং এলাকার লোকদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে আসামির বাবাও মারা যান। আমি মনে করি, মামলাটি জমি-সংক্রান্ত বিরোধের। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আসামি প্রতিকার পাবেন।’
এর আগে গতকাল সোমবার রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ঠিক করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার আগে গত ৮ জুলাই রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
৪ জুলাই এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়ে সর্বশেষ ৮ জুলাই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষের পর রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
Advertisement
আসামির বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ (আইও) প্রসিকিউশনের আনা ১৫ জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি পেশ করেন। অন্যদিকে, আসামির পক্ষে কোনো সাফাই (ডিফেন্স) সাক্ষী ছিল না। আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর ঋষিকেশ ও জাহিদ ইমাম। আসামির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান।
মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত চলাকালীন নাশকতার অন্য এক মামলায় গ্রেফতার হন আসামি আব্দুস সামাদ ওরফে ফিরোজ খাঁ ওরফে মুসা। ২০১৭ সালে ২৪ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুঠিয়ার বাঁশবাড়ী এলাকার মৃত আব্বাস আলীর ছেলে মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁ মুক্তিযুদ্ধের আগে মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে শান্তি কমিটির স্থানীয় নেতার নেতৃত্বে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন।
প্রতিবেদনে আসামি ফিরোজ খাঁর বিরুদ্ধে চারজন সাঁওতালসহ ১৫ জনকে হত্যা, ২১ জনকে নির্যাতন, ৮ থেকে ১০টি বাড়িঘর লুণ্ঠনসহ ৫০ থেকে ৬০টি বাড়িঘর অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে পুঠিয়া থানার ভালুকগাছী ইউনিয়নের সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে আসামি ফিরোজ খাঁ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীরা স্বাধীনতার পক্ষের হেমব্রম, কানু হাসদা, জটু সরেন ও টুনু মাড্ডিকে তরবারি দিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।
২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর মামলাটির তদন্ত শুরু হয়। তখন এ মামলায় আসামি করা হয় ছয়জনকে। কিন্তু তদন্ত চলার সময়ই বাকি পাঁচ আসামির মৃত্যু হলে একমাত্র আসমি হিসেবে মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁই থাকেন।
আসামির বিরুদ্ধে চার অভিযোগ
অভিযোগ ১ : একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের দমদমা, সুখদেবপুর, বাঁশবাড়ি ও গতিয়া গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
অভিযোগ ২ : একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার গণ্ডগোহালী, চকপলাশী, বৈরাগীবাজার ও বাঁশবাড়ি গ্রামে ছয়জনকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
অভিযোগ ৩ : একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের পশ্চিমবাগ গ্রামের সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যা।
অভিযোগ ৪ : একাত্তরের ২০ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের ঢোকরাকুল গ্রামে একজনকে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
এফএইচ/এসআর/পিআর/এমকেএইচ